উচ্চশিক্ষার শুরুতে সাবজেক্ট বাছাই দ্বন্দ্বে পড়েনি এমন শিক্ষার্থী পাওয়া দুস্কর। তবে আজকে ভালো একটি সাবজেক্ট সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলি। আর ক্যাপশন দেখে নিশ্চয় বুঝে গেছেন আজকের আলোচনার বিষয় বংলা সাবজেক্ট রিভিউ। বাংলা সাবজেক্ট রিভিউ এর আদ্যোপান্ত নিয়েই থাকছে আমাদের আজকের এই আর্টিকেল । আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করছি তাই এই বাংলা সাবজেক্ট নিয়ে মোটামুটি ভালো ধারনা হয়েছে। বাস্তবতা ও ইতিহাস ঐতিহ্যের মানদন্ডে চলুন বাংলা বিভাগকে পরিমাপ করি। একটা পরিষ্কার ধারণা দিতে লেখাটা বড় মনে হতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ লেখাটা মনো্যোগ দিয়ে পড়লে আশা করি উপকৃত হবেন।
আর্টস এবং সোস্যাল সাইন্স ফ্যাকাল্টির অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার ম্যাধ্যমে চাকুরিতে যোগ দান করে থাকে। বিসিএসে যে সকল সাবজেক্টে স্পেশ্যাল সেক্টর আছে তাদের বিসিএস সাধারণ ক্যাডার না হলেও স্পেশ্যাল ক্যাডারে চাকুরি হয়ে যায়। বাংলা বিভাগের শিক্ষা ক্যাডার থাকার কারণে চাকুরিতে ক্ষেত্র বেশি। সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ জুড়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকতার
অন্যান্য বিভাগের তুলনায় বাংলা বিভাগের স্কলারশিপের সুযোগ সীমিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে স্কলারশিপের তেমন কোনো সুযোগ নেই। এর প্রধান কারণ হতে পারে বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া পৃথিবীর আর কোন দেশে বাংলা বিভাগ বা বাংলা বিষয় পড়ানো হয় না। পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয়-এ বাংলা বিভাগ প্রচলিত থাকলেও তা খুবই সীমিত। তবে বাংলাদেশে বাংলা বিভাগের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
যদি কোনো শিক্ষার্থীর বাইরের দেশে পড়াশোনা করার ইচ্ছা থাকে তাহলে উক্ত শিক্ষার্থীর বাংলা সাবজেক্ট চয়েজ না করাই উত্তম।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু টিউশন পাওয়া যায় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হলে। কারণ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা ব্যাকরণ এবং সাহিত্য আবশ্যক একটি বিষয়। তাই বাংলা শেখার গুরুত্ব অপরিসীম হওয়ায় সচেতন অভিভাবকেরা স্পেশালভাবে বাংলা টিউটর খোঁজেন। কেননা জীবনের পরবর্তী সময় গুলোতে বাংলা ব্যবহার করতে হয় প্রায় সবাইকেই।
কেউ যদি পড়াশোনা শেখার পরেও বাংলা বানান ভুল করে, নির্ভুলভাবে উচ্চারণ করতে না পারে এবং বাক্য গঠন করতে না পারে তাহলে তাকে উপহাস করা হতে পারে। তাই বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হলে বেশকিছু টিউশন আপনার নাগালে থাকবে যদি আপনি খোঁজ নেন।
টিউশনি পাওয়ার জন্য অবশ্যই আপনাকে সক্রিয় থাকতে হবে। বিভিন্ন টিউশন মিডিয়ার গ্রুপে যুক্ত হতে হব, তাদের বিভিন্ন ফরম পূরণ করে রাখবেন। টিউশন মিডিয়ার কাছে বাংলা বিভাগের কোনো শিক্ষার্থীর প্রয়োজন হলে তারা আপনাকে ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে নক করবে।
বাংলা সাবজেক্ট এর কিছু পার্টটাইম জবের সুযোগ রয়েছে। তবে বরাবরের মত টিউশন পেতে যেমন আপনাকে অনেকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে আপনাকে বুঝতে হবে যে কোথায় যোগাযোগ করলে পার্ট টাইম জব পাওয়া যেতে পারে। যোগাযোগের দক্ষতা থাকলে পার্টটাইম জবের সুযোগ মেলে। বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করলে যে সকল পাট টাইম জব আপনি করতে পারবেন তার সামান্য কিছু ধারনা এখন আপনার সাথে শেয়ার করব।
বিভিন্ন গ্রন্থের অনুবাদের কাজ পাওয়া যায়। যেখানে মোটামুটি ভালো মানের সেলারি পাওয়া সম্ভব। বাংলা আর্টিকেল লিখে আয় করতে পারবেন। আমাদের ওয়েবসাইটে চাইলে আপনি কোর্স করে আর্টিকেল লেখক হিসেবে কাজ করতে পারবেন। বিভিন্ন গ্রন্থ বা বাজারে প্রকাশের জন্য বইগুলোর বানান ঠিক করার কাজ পাওয়া যায়।
পড়াশোনার চাপ নেই বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া যায় এমন কোন সাবজেক্ট বা বিষয় নেই। তবে কিছু কিছু ডিপার্টমেন্ট বা বিভাগের পড়াশোনার চাপ তুলনামূলক কম। আপনি যদি বাংলা বিভাগ নির্বাচন করেন তাহলে অন্যান্য বিভাগের তুলনায় একটু বেশি পড়াশোনা করতে হবে। তবে কোনো শিক্ষার্থী যদি প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘন্টা পড়াশোনা করে তাহলে তার পক্ষে বাংলা সাবজেক্ট এ টপ রেজাল্ট করা অসম্ভব কিছু নয়।
শিক্ষকদের আন্তরিকতা কেমন?
আমরা যখন স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেছি তখন যেমন দেখেছি কিছু শিক্ষক অনেক আন্তরিক থাকেন আবার বিপরীতক্রমে কিছু শিক্ষক থাকেন একদমই কট্টরপন্থী। শুধু বাংলা বিভাগ নয় এটা দেখা যায় প্রতিটি বিভাগ, প্রতিটি কলেজ, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে।
এরই ধারাবাহিকতায় আপনি বাংলা বিভাগের বা বাংলা সাবজেক্ট এর কিছু শিক্ষককে অত্যন্ত আন্তরিক হিসেবে পাবেন। অন্যদিকে কিছু কট্টরপন্থী শিক্ষক ও আপনি পাবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের সাথে বুঝে শুনে কথা বলা উচিত।
বাংলা বিভাগের পড়াশোনার পরিবেশ গতানুগতিক ধারায় প্রচলিত। অন্যান্য ক্লাস রুমের মত এখনো আধুনিক ক্লাসরুম হয়নি। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাসরুম ও বিজনেস ফ্যাকাল্টির ক্লাস রুমগুলো যেমন সাজানো গোছানো ও আকর্ষণীয় আর্টস ফ্যাকাল্টির ক্লাসরুমগুলো ঠিক তেমন সাজানো-গোছানো আকর্ষণীয় নয়। বাংলা বিভাগ ও ইংরেজি বিভাগসহ আর্টস ফ্যাকাল্টির সকল বিভাগের একই দশা।
তবে পড়াশোনার পরিবেশ এর কথা যদি বলতে যাই বাংলা বিভাগের একটি সমৃদ্ধ ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরী আছে। যেখানে আপনি সকল ধরনের বইয়ের পাশাপাশি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন, যা আপনাকে মুগ্ধ করবে।
সুবিধার কথা যদি বলতে যাই তাহলে অনেক কথাই চলে আসে। বাংলা বিভাগ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সব সময়ের সেরা। বাংলা বিভাগের জ্ঞানী শিক্ষকদের সংখ্যা অন্যান্য বিভাগের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশের কয়েকজন বুদ্ধিজীবীদের নাম বলতে গেলে প্রথম সারিতেই চলে আসে বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের কথা। বাংলা বিভাগ বা বাংলা সাবজেক্ট নিয়ে পড়াশোনা করলে বিসিএস বাংলা সিলেবাস কমপ্লিট হয়ে যায়। এছাড়াও বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে পর্যাপ্ত শিক্ষা ক্যাডার এ চাকরির সুযোগ থাকে।
বাংলা বিভাগের সম পর্যায়ের কলাভবন বা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের যে সাবজেক্ট রয়েছে উক্ত সাবজেক্ট গুলো তে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশন বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করার তেমন সুযোগ নেই। এদিক থেকে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য টিউশন এবং কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেওয়ার ভালো সুযোগ পায়। পাশাপাশি সাহিত্যকে জানার বিশ্লেষণ করার এবং সাহিত্য রচনা করার থাকছে অপার সম্ভাবনা।
অসুবিধার কথা বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে স্কলারশিপের কথা। বাংলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করলে ইউরোপ-আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার দেশগুলোতে স্কলারশিপের সুযোগ নেই। দীর্ঘদিন বাংলা মিডিয়ামে পড়া( করা হয় ফলাফল স্বরূপ দীর্ঘদিন ইংরেজি চর্চা না থাকায় চাকরির পরীক্ষায় ভুগতে হয়। তাই বাংলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করলে ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনার পাশাপাশি ইংরেজি চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা শুরুতে অনেকেই বাংলা বিভাগকে তেমন মূল্যায়ন না করেই তাচ্ছিল্য করবে। ক্লাস রুম গুলো হয়তো পছন্দ হবে না। বাংলা বিভাগের যথেষ্ট গৌরব ও ঐতিহ্য থাকা সত্বেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিতে সংকোচ বোধ করেন।
বাংলা বিভাগ নিয়ে আমজনতার ভাবনা একদমই যে ইতিবাচক সেটা বলবো না। সাধারণ মানুষ মনে করেন বাংলা সাবজেক্ট নিয়ে যারা পড়াশোনা করে, তাদেরকে অনেক কে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেন। অনেকে মনে করেন বাংলা বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে আর কি বা হবে, ইংরেজি নিয়ে পড়লে হয়তো ভালো হতো। বাংলা বিভাগ নিয়ে আমজনতার ধারণা প্রায় নেতিবাচক।
কোথায় কোথায় বাংলা সাব্জেক্ট পড়ানো হয়?
বাংলাদেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাবজেক্ট পড়ানো হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোতে শুধু বাংলা সাবজেক্ট পড়ানো হয় না, তাছাড়া সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বাংলা সাবজেক্ট পড়ানো হয়।
বাংলা ভাষা’ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ভাষা। এই শ্রুতিমধুর নান্দনিক ভাষাটি নিয়ে উচ্চতর পর্যায়ে পড়াশোনা করাটা অনেকের কাছেই অধীর আগ্রহের বিষয়। আবার একজন বাঙালি হিসেবে মাতৃভাষা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষণা করতে পারাটা গর্ববোধের জায়গা।তাছাড়া বাংলার শিক্ষার্থীরা চিন্তায় ও মননে হয় মার্জিত, পরিশীলিত ও সুদর্শন এবং জীবন সম্পর্কিত গভীর দর্শন বোধই এদের অন্যন্য করে তোলে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকা সাবজেক্ট টি হলো বাংলা।
বাংলা বিভাগে সাধারণত বাংলা ভাষা ব্যাকরণের উচ্চতর জ্ঞান, বাংলা সাহিত্যের কলাকৌশল, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, বিভিন্ন উপন্যাস, বড় বড় কবিদের বিখ্যাত কবিতা, বড় বড় সাহিত্যিকদের বিভিন্ন গদ্য পড়ানো হয়। এছাড়া ফাউন্ডেশন কোর্স হিসেবে এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, বাংলা, সাংবাদিকতা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান এই বিষয়গুলোও সংক্ষিপ্ত কোর্স হিসেবে পড়ানো হয়ে থাকে। আপনি যদি ১ সেমিস্টারে বা ৪ মাসে ১৬ টি কাব্যগ্রন্থ,১৬ টি উপন্যাস,১৬ টি গল্পগ্রন্থ,১৬ টি নাটক পড়ার ইতিহাস গড়তে চান তাহলে বাংলা বিভাগ আপনার জন্য। তবে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, রাত জেগে নোট করতে হবে৷ পড়াশোনা করলে রেজাল্ট ভালো করা কঠিন নয়।
বাংলা বিভাগ মানেই আপনার সাথে বিখ্যাত বিখ্যাত কবি, পাঠক, শিক্ষক, লেখক, সাহিত্যিকদের দেখা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ মানেই শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড.আনিসুজ্জামান, সৈয়দ আজিজুল ইসলাম, হুমায়ুন আজাদ, মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা প্রমুখের স্মৃতি বিজরিত বিভাগ৷
বাংলা বিভাগের উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। এছাড়া ভারতসহ অন্যান্য কিছুদেশে এ
বিষয়ের উপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ তো আছেই।
বাংলা বিভাগ থেকে উত্তীর্ণ হবার পর শিক্ষার্থীরা সাধারণত বিসিএস-এর মাধ্যমে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করে।
এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের শিক্ষকহি সেবে, বিভিন্ন প্রাইভেট ফার্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকের চাকুরিকে তারা পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। বাংলা বিভাগের স্টুডেন্ট হওয়ায় ছাত্রাবস্থায় প্রচুর টিউশন, প্রুফ রিডিং, সাংবাদিকতা ও খন্ডকালিন চাকরির সুযোগ তো থাকছেই।
আপনি যদি সংস্কৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্ধ সম্পর্ক রাখতে চান তাহলে আপনি নিজেকে প্রমাণ করার অনেক সুযোগ পাবেন বাংলা বিভাগে।মোট কথা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংস্কৃতি, পরিশ্রম, শিক্ষা অপরিহার্য - কষ্ট নেই মেনে নিতে হবে, তাই রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে বলতে চাই-
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url