শরীয়তপুর জেলা তার জনপ্রিয় দার্শনিক স্থানগুলোর জন্য বিখ্যাত। শরীয়তপুর জেলার নামটি বিখ্যাত সমাজসংস্কারক হাজী শরীয়তউল্লাহর নামানুসারে রাখা।বিক্রমপুরের দক্ষিণাঞ্চল ও বরিশালের ইদিলপুর পরগণার কিছু অংশ নিয়ে বর্তমান শরীয়তপুর জেলা গঠিত। জেলাটির আয়তন প্রায় ১৩৬৩.৭৬ বর্গ কিলোমিটার।শরীয়তপুর জেলা পূর্বে ফরিদপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮৪ সালে শরীয়তপুর জেলা হয়। ১৯৭৭ সালে সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর নামানুসারে শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়। শরীয়তপুরের বর্তমানে ৭টি থানা ও ৬টি উপজেলা রয়েছে। শরীয়তপুরের সাতটি থানার নাম হলো- শরীয়তপুর সদর, জাজিরা, নড়িয়া, ডামুড্যা, গোসাইরহাট, ভেদরগঞ্জ ও নতুন থানা সখিপুর। নড়িয়া থানায় সবচেয়ে বেশি ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান রয়েছে। নড়িয়া থানা তাই প্রায় সকলের কাছেই েপরিচিতআর। শরীয়তপুরের ছয়টি উপজেলার নাম হলো- শরীয়তপুর সদর, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ, জাজিরা, ডামুড্যা, গোসাইরহাট। এই ছয়টি উপজেলায় রয়েছে এগুলোর পরিচয় বহনকারী বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। মোঘল আমল ছাড়াও রয়েছে মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম যা নতুন তৈরি হয়েছে। মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে। শরীয়তপুরের রয়েছে পুরোনো ঐতিহ্য, রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থানগুলো বহু আগে থেকেই দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছে। যেকোনো জায়গার রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু দর্শনীয় স্থান যা তার পরিচয় বহন করে। শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোও বহন করছে এখানকার ইতিহাস ঐতিহ্যের ছাঁপ, নতুন যোগ হয়েছে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান। আজ শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর কথাই জানবো আমরা।
শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো জেড এইচ সিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয় হলেও শরীয়তপুরের উচ্চশিক্ষার প্রসার সম্পর্কে জানার একটি অন্যতম উপায় জেড এইচ শিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের মধুপুর গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত। শরীয়তপুর থেকে বাসে বা অটোতে করে ভেদরগঞ্জ পৌঁছানো যায়। এরপর সেখান থেকে রিক্সায় করে মধুপুর গ্রামে যাওয়া যায়। মধুপুর গ্রামেই বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান।বিশ্ববিদ্যালয়টি আধুনিক সব সরঞ্জাম ও সুযোগ সুবিধায় পূর্ণ। রয়েছে ল্যাব, লাইব্রেরি সহ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ।বিশ্ববিদ্যালয়টির আচার্য মাননীয় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য তালুকদার মোহাম্মদ লোকমান হাকিম। শহুরে কোলাহল মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় জেড এইচ শিকদার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রায় ৬ একর বিস্তৃত জায়গা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে। এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। দেখতে মনোরম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য এক চমৎকার সুযোগ উন্মুক্ত করেছে।
রুদ্রকর মঠের অবস্থান শরীয়তপুরের রুদ্রকর ইউনিয়নে। শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে ইঞ্জিনচালিত অটোতে করে রুদ্রকর ইউনিয়নে এবং সেখান থেকে রুদ্রকর জমিদার বাড়ি গেলেই রুদ্রকর মঠ দর্শন করা যাবে। শরীয়তপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মঠটি। রুদ্রকর মঠ শরীয়তপুরের একমাত্র মঠ। রুদ্রকর মঠ মূলত মন্দির। এর মধ্যে একটি বড় মন্দির ও চারটি ছোট মন্দির রয়েছে। ধারণা করা হয় মঠটি নির্মান করা হয়েছিল নবাব আলীবর্দি খানের আমলে। জমিদার গুরুচরণ চক্রবর্তীর মাতা রাশমনি দেবীর সমাধিকে অমর করে রাখার জন্য এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। শ্মশান মন্দির বলা হয় এটিকে তাই। এই শ্মশান মন্দিরের মূল উপসনালয় কক্ষের বারান্দায় চার কোণায় চারটি ছোট মন্দির। ছোট মন্দিরগুলোর উচ্চতা ১.৯৫ মিটার এবং বড়টির উচ্চতা ২০ মিটার। রুদ্রকর মঠের গায়ে চারটি দেবী মূর্তির অলঙ্করণের নিদর্শন রয়েছে। ১৮৯৮ সালে এই মঠটি পুনর্নির্মাণ করা হয়। মঠটির সামনে একটি পুকুরও রয়েছে। রুদ্রকর মঠের মন্দিরে প্রতিবছর পূজার আয়োজন করা হয়।
ধানুকা মনসা বাড়ি শরীয়তপুরের পুরোনো ঐতিহ্য বহন করে। ধানুকায় একসময় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘটা করে পূজো হতো।শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে অটোতে করে ধানুকা মনসা বাড়ি যাওয়া যায়। প্রায় ছয়শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী স্থান ধানুকা মনসা বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এটি ময়ূর ভট্টের বাড়ি নামে পরিচিত। ময়ূর ভট্ট ধানুকা গ্রামে বাস করতো। প্রচলিত আছে মনসা একদিন স্বপ্নে ময়ূর ভট্টকে আদেশ দেন তার মন্দির নির্মাণ করে পূজো প্রচার করার। দেবী কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ধানুকা গ্রামে মনসা মন্দির স্থাপিত হয়।তখন থেকেই ময়ূর ভট্টের বাড়িটি ধানুকা মনসা বাড়ি নামে পরিচিত। এখানে সুলতানী ও মোঘল আমলে নির্মিত ৫টি ইমারত রয়েছে।এগুলো হলো - দূর্গা মন্দির, মনসা মন্দির, কালি মন্দির, নহবতখানা এবং আবাসিক ভবন। এই মনসা বাড়িতে একটি পিতলের মূর্তিও ছিল।পিতলের মূর্তিটি একসময় হারিয়ে গিয়েছিল।১৯৭৩ সালের দিকে ধানুকা মনসা বাড়ি থেকে ইতিহাস গবেষক জালাল উদ্দীন আহম্মেদের কাঠের বাঁধাই করা তুলট কাগজে লিখিত পুথি উদ্ধার করা হয়।উদ্ধারকৃত পুঁথি এখন শরীয়তপুরের বেসরকারি পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। দর্শনার্থীদের জন্য এই স্থানটি ভ্রমণ করার জন্য উপযুক্ত।
ফতেহজংপুর দূর্গ শরীয়তপুরের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান। দুর্গটি নড়িয়া উপজেলায় অবস্থিত। মোঘল আমলের ঐতিহ্য বহনকারী স্থান ফতেহজংপুর। মোঘল আমলে সেনাপতি মানসিংহ কর্তৃক জায়গাটির নাম হয় ফতেহজংপুর। মোঘল সেনাপতি মানসিংহ যখন বিক্রমপুর আক্রমণ করেন তখন তার সহযোগী যোদ্ধারা এখানকার তৎকালীন রাজা কেদার রায় কর্তৃক পরাজিত হয়ে শ্রীনগরে আশ্রয় নেয়। তখন রাজা মানসিংহ তাদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন ফলে দুপক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কেদার রায় পরাজিত হয় ও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মানসিংহ তার জয়ের চিহ্ন স্বরূপ জায়গাটির নাম পরিবর্তন করে নাম রাখেন ফতেহজংপুর। এখন এই স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে, মোঘল আমলের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিচিত করায় ফতেহজংপুর দুর্গ।
সুরেশ্বর দরবার শরীফ শরীয়তপুর জেলার পরিচিত একটি দর্শনীয় স্থান। সুরেশ্বরে জন্মেছিল হযরত শাহ সুরেশ্বরী (রহঃ)। সুর বা সঙ্গীত ছিল তার ইসলাম প্রেমের মাধ্যম।সুরেশ্বরী (রহঃ) সঙ্গীতের মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসুল(স.) এর প্রতি তার প্রেমানুরাগ প্রকাশ করতেন। প্রতি বছর এখানে সুরেশ্বরী (রহঃ) এর অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী আসে সুরেশ্বর দরবার শরীফ দর্শন করতে। এটি স্থানীয়দের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান।
জমিদার বাড়ি ও বাহাদুর খলিলুর রহমান সিকদারের বাসস্থান শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত ছঁয়গাও ইউনিয়নে। দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে এটি জনপ্রিয় । ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলের অনেক হিন্দু জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে। খান বাহাদুর খলিলুর শিকদারের বাড়িও এখানে। স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থান মহিষারের দীঘি
মহিষারের দিগম্বরী দীঘি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এই দীঘিটি প্রায় ছয়শত বছরের পুরোনো। মোঘল আমলে ১২ ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া বিক্রমপুর পরগণার জমিদার রাজা চাঁদ রায় দিগম্বরীর দীঘিটি খনন করেন। দীঘিটির চারপাশে সন্ন্যাসী বাড়ি, মেলা চত্ত্বর, জোড়া পুকুর, মনসা মন্দির, কালি মন্দির ও লক্ষ্মী মন্দির সহ অসংখ্য স্থাপনা রয়েছে। এই দীঘিটি ১৯৮২ সালে পুনঃখনন করা হলে সেখান থেকে বেয়াল্লিশ কেজি ওজনের কষ্টি মূর্তিসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। স্থানীয়দের ধারণা মহিষারের দীঘিতে গোসল করলে পাপ ও রোগ মুক্তি ঘটে। তাই দূর-দূরান্ত থেকে অনেক দর্শনার্থীদের ভীড় জমে এখানে। অনেকে বিভিন্ন মানত রেখে আসে পূরনের জন্য। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্যও এটি জনপ্রিয়। প্রতি শনি ও মঙ্গলবার হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজোর আয়োজন করা হয়ে থাকে। মহিষারের দীঘি এখনও ঐতিহ্য বহন করে শরীয়তপুরের। শীতকালে এখানে অনেক অতিথি পাখি আসে।তখন দর্শনার্থীদের সংখ্যাও বেড়ে যায়।
রামসাধুর আশ্রম শরীয়তপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান
রামসাধুর আশ্রম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ার ডিঙ্গামানিক ইউনিয়নে অবস্থিত। রামসাধুর আশ্রম প্রায় শত বছরের ঐতিহ্য বহন করে। প্রতিবছর এ আশ্রমকে কেন্দ্র করে তিন দিনের মেলা বসে। মেলায় দর্শনার্থীদের প্রচুর ভীড় হয়।
বুড়ির হাট ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ ভেদরগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। শরীয়তপুর জেলায় ইসলামী স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন বুড়িরহাট জামে মসজিদটি। অনুমান করা হয় প্রায় একশত বছর পূর্বে এটি নির্মিত হয়। মসজিদটিতে রয়েছে অসাধারণ কারুকার্য। মসজিদটি নির্মানে ইংল্যান্ড থেকে কংক্রিট, সিমেন্ট এবং কলকাতা থেকে দামী পাথর আনা হয়। আশির দশকে মসজিদের বর্তমান বৃহৎ মিনারটি নির্মান করা হয়। মসজিদটির সৌন্দর্য তার বিশিষ্ট কারুকাজ। এই কারুকাজ দেখার জন্য আশেপাশের এলাকার মানুষজন সহ দর্শনার্থীদের ভীড় জমে এখানে।
মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের কলুকাঠি গ্রামে অবস্থিত। এটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি। নড়িয়া উপজেলার আধুনিকতার পরিচয় বহন করে এই মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম। মডার্ন হারবাল গ্রুপের চেয়ারম্যান ডা. আলমগির মতি প্রায় ৫০ একর জমি নিয়ে ২০১১ সালে এটি নির্মান করেন। শরীয়তপুর জেলার একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র নামে পরিচিত এই মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম। এখানে রয়েছে চিড়িয়াখানা, বিভিন্ন ধরনের রাইড, স্পীড বোট, সুপার চেয়ার, ট্রেন, ওয়াটার রাইড, শিশু রাইড, ওয়াটার হুইল, মেরি রাউন্ড, ক্যাবল কার ইত্যাদি। বিভিন্ন ফলজ ও ঔষধি গাছের সমাহার রয়েছে এই মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডমে। এছাড়া দুইটি খেলার মাঠ ও একটি বিশাল আয়তনের পুকুরও রয়েছে। চিড়িয়াখানায় রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পশু,পাখি, যেমন- কুমির, হরিণ, চিতাবাঘ, অজগর সাপ, ময়ূর, সজারু, খরগোশ, কাছিম, উটপাখি, ভাল্লুক, বানর সহ আরো বিভিন্ন পশুপাখি। পুকুরে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এই বিনোদন কেন্দ্রটি প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা বিবেচনায় রয়েছে সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা ও পাহারাদার। শরীয়তপুর জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এখন মডার্ন ফ্যান্টাসি কিংডম।
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url