OrdinaryITPostAd

২৩ আগস্ট কালো দিবস


আজ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিন্দনীয় সেই ‘২৩ আগস্ট কালো দিবস’। ২০০৭ সালের ২০-২৩ আগস্ট, তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মদদে সেনাসদস্য কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রহৃত হওয়ার ঘটনা ও ছাত্র- শিক্ষকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্মম নির্যতন এবং গ্রেফতারের ন্যাক্কারজনক ঘটনার স্মরণে প্রতিবছর ২৩ আগস্ট গভীর শোকের সাথে ‘২৩ আগস্ট কালো দিবস’ পালন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজকে রাতে গেলে আমরা আপনাদের সাথে শেয়ার করব ২৩ আগস্ট কালো দিবসের বেদনার ইতিহাস।



২৩ আগস্ট, ‘কালো দিবসের’ সুত্রপাতঃ–
২০০৭ সালের শুরুতে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশে জরুরি অবস্থা সচল রেখে।ওই বছর ২০ আগস্ট  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ফিল্ডে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্রদের মধ্যে আন্তঃবিভাগ ফুটবল খেলা চলছিল।মাঠের পাশেই ছিল অস্থায়ী সেনা ছাউনি। খেলা চলাকালীন তুচ্ছ বিষয়ের জের ধরে ছাত্র ও সেনা সদস্যদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে ঘটে যায় এক অপ্রীতিকর ঘটনা যা জন্ম দেয় আজকের কলঙ্ক মাখা ‘২৩ আগস্ট কালো দিবসের’।ছাত্র ও সেনাসদস্যদের মধ্যে বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে কিছু ছাত্রকে ধরে সেনা ছাউনিতে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ছাত্রদেরকে প্রহৃত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সেনাসদস্যদের দ্বারা শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম।উপস্থিত ছাত্ররা এ ঘটনার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়।




২৩ আগস্ট কালো দিবসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘সেনা হটাও’ আন্দোলনঃ–

সেনাসদস্য কর্তৃক ছাত্র-শিক্ষক উৎপীড়নের ঘটনা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদ আর ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা।এরপর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিলে সেনাসদস্যদেরকে ছাত্রদের নিকট ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায় ছাত্ররা।সেনাবাহিনী ছাত্রদের দাবি মানেনি; উপরন্তু ছাত্রদের প্রতিবাদ মিছিলে আক্রমণ করে।পুলিশ ও সেনাবাহিনীর এমন হীন আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে অস্থায়ী সেনা ছাউনি গুটিয়ে নেওয়া এবং এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় উৎপীড়িত ছাত্ররা।

পরদিন ২১ আগস্ট, নির্যাতনের প্রতিবাদে আবারও মিছিল নামে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়।মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা।রণাঙ্গনে পরিণত হয় নীলক্ষেত-কার্জন হল থেকে শুরু করে পুরো ক্যাম্পাস।ছাত্র ও পুলিশের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত হয় অনেক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের ওপর সেনাবাহিনী চড়াও হওয়ায় ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে।বিশেষত, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।সারাদেশে শুরু হয় ‘সেনা হটাও’ আন্দোলন।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তীব্র তোপের মুখে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ থেকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প সড়িয়ে নিতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সেনাবাহিনী।

এদিকে ২২ আগস্ট, আন্দোলনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে।রাজশাহীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় রিকশা চালক আনোয়ার।পরিস্থিতি আর জটিল হয়ে উঠলে দেশের প্রধান প্রধান বিভাগীয় শহর গুলোতে কারফিউ জারি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওইদিন সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাবির আবাসিক হলের ছাত্র-ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে অনির্দৃষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলো।

২৩ আগস্ট ‘কালো দিবসে’ শিক্ষক হয়রানিঃ–

২৩ আগস্ট রাতে কোয়ার্টার থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ও অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদকে।তাদেরকে অজানা স্থানে নিয়ে অকথ্য অত্যাচার করে স্বৈরাচারী শাসকদলের সেনারা।আরো দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়।এছাড়াও আন্দোলনে সংহতি প্রকাশের অভিযোগে আটক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইদুর রহমান খান , আবদুস সোবহান, মলয় কুমার ভৌমিক, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস, আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং সেলিম রেজাকে।সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি পোড়ানো দায়ে ৭ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে সেনা সমর্থিত সরকার।এছাড়াও সারাদেশে ২৮ হাজার ছাত্রকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়।এ ঘটনায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ ঘটনার টানা ৬৬ দিন পর খুলে দেয়া হয় ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন গুলো নির্য়াতনবিরোধী ব্যানারে মাঠে নামে। বেগবান হয়ে ওঠে গ্রেফতারকৃতদের মওকুফের আন্দোলনও।ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তির আন্দোলনের কাছে নত শিকার করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সরকার। অবশেষে  তীব্র আন্দোলনের চাপে কোনঠাসা হয়ে আটককৃত ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি দেওয়া হয়।এই নিন্দনীয় ঘটনার পরবর্তী বছর (২০০৮)থেকে প্রতিবছরই গভীর শোকে দিনটিকে 'কালো দিবস' হিসেবে পালন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার।

‘২৩ আগস্ট কালো দিবস’ নিয়ে শিক্ষকদের মনোভাবঃ–

আগস্টের ছাত্র বিক্ষোভ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের ঘটনা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কি অর্জন করেছে সে সম্পর্কে শিক্ষকেরা মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি তাজমেরী এস এ ইসলাম বলেন,“ছাত্র ও শিক্ষকদের মুক্তি তাঁদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ ঘটনা থেকে তাঁদের অর্জন বলতে গেলে শূন্য”।আরেক অধ্যাপক হারুন-অর রশীদ বলেন, “সরকারের কাছে অগাস্টের ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনাটি বিশেষ বার্তাবাহী।সরকার উপলব্ধি করেছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যায়, কিন্তু কারারুদ্ধ করে রাখা যায় না”।উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো.আখতারুজ্জামান নতুন প্রজন্মকে কালো দিবসের সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার। স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা অগণতান্ত্রিক যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাহসী কথা বলার ইতিহাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি মানবতাবাদী ও উদার নৈতিক, যা সবসময়ই জয়ী হয়েছে।”



ঢাবি কিভাবে পালন করে আসছে ‘কালো দিবস’–

প্রতিবছর ২৩ আগস্ট কালো দিবস বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ‘কালো দিবস’ পালন করে আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।শোকের স্মৃতি নির্দেশক হিসেবে কালো কাপড়ের টুকরো নিজেদের অঙ্গে জড়িয়ে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়টির মর্মাহত ছাত্র-শিক্ষকেরা।প্রতিবছর ‘কালো দিবসকে’ উপলক্ষ করে সাড়ে ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাপতিত্বে ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এবছরও ‘কালো দিবস’ পালন করা হবে বলে শনিবার (২১ আগস্ট) ঢাবি গণসংযোগ দফতরে পরিচালক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবছর কালো দিবস পালন উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি অনুযায়ী আগামী ২৩ আগস্ট (সোমবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ কালো ব্যাজ ধারণ করবেন।এদিনে সকাল ১১টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো.  সভাপতিত্বে প্রশাসনিক ভবনস্থ অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।





এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url