অলৌকিক মায়ার জগৎ কী? কী উপায়ে অলৌকিক মায়ার জগৎ নির্মিত হয় বিশ্লেষণ

'অলৌকিক মায়ার জগৎ কী?  কী উপায়ে অলৌকিক মায়ার জগৎ নির্মিত হয়?'  বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই নোট করেছিলাম তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্টিকেল রাইটিং সংগঠন এর ওয়েবসাইটে আজকে বাংলা বিভাগের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলাম আশা করি 'অলৌকিক মায়ার জগৎ কী?' এটা নিয়ে আর কোন বিভ্রান্তি থাকবে না। 



কবির বাঙনির্মিতি  মূলত কাব্য। কবির নিপূণ কর্ম বা সৃষ্টি বলেই শব্দময় শিল্পের নাম কাব্য। কবিতার আশ্চর্য প্রতিভাবলে বস্তুরাশির শব্দের সমর্পিত করলে বিশ্বমান জগতের বাইরে যে বিচিত্র মায়ার জগৎ সৃষ্টি করে,  আসলে কাব্য কবির বাঙ নির্মিতি,  কবি যেটাকে নির্মাণ করে সেটাকে আমরা বলে থাকি কাব্য। বাহ্য জগতের রুপ রস গন্ধ কবির মনের মধ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে যে একটি বিচিত্র মায়ার জগৎ নির্মিত হয় বা দৃশ্যমান জগতের বাইরে আরেকটি জগত নির্মিত হয় যা আমাদের চেনা পরিচিত জগতের  বাইরের জগতের মত সেটিকে বলা হয় অলৌকিক মায়ার জগৎ।  মূলত সংস্কৃত সাহিত্য তাত্ত্বিকেরা কাব্য কি? কাব্যের উৎস কি? কবিতায় কবি কিভাবে লেখেন? এ বিষয়ে নানা জটিল তর্কে-বিতর্কে সমালোচনা দ্বারা ব্যপ্ত থাকে। এবং কাব্যের  প্রকাশ প্রক্রিয়া বা উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা একসময় অলৌকিক মায়ার জগত প্রসঙ্গে অবতারণা করেন। তাঁরা অলৌকিক মায়ের জগত সম্পর্কে অবগত হন। এই কৌতুহল থেকে তারা এক পর্যায়ে কাব্যের আত্মা কি? এর অনুসন্ধান করতে গিয়ে তাঁরা এক পর্যায়ে অলৌকিক মায়ের জগতের সিদ্ধান্তে পৌঁছান। সুতরাং কাব্যের জগতকে অলৌকিক মায়ার জগৎ এবং এই মায়ার  জগত কি?  এবং কিভাবে কোন কৌশলে এই অলৌকিক নির্মিত হয়?  সে বিষয়ে এই আলোচনা করব।

   বাহ্য জগৎ ও অন্তর জগৎ এই দুই জগতের সমন্বয়ে তৈরী হয় কাব্যের জগৎ মূলত বাহ্য জগৎ বাইরের রুপ, রস,  গন্ধ ও প্রকৃতি অর্থাৎ বাইরের জগৎ এবং অন্তর জগৎ এর দ্বারাই তৈরি হয় অলৌকিক মায়ার জগৎ বা কাব্যের জগৎ।  একজন কবি  শুধু নিজের মনের মতো কাব্য লিখতে  পারেন না।  সেখানে বাহ্য জগৎ ও অন্তর জগৎ বিদ্যমান থাকতে হয়। ব্যবহারিক জীবনে সুখ, হাসি,  আনন্দ, হর্ষ ও বেদনা এগুলোর নানা লৌকিক কারণে ব্যক্তিমনেও নানা আনন্দ,  বেদনা,  শোক ও হর্ষ এগুলোর জন্ম দেয়, ভাবের জন্ম দেয়। বাইরের জগতের কোন ঘটনা  আধার প্রাপ্ত হয়ে যদি আনন্দিত  হয় তাহলে বাহ্য জগতের ঘটনাবলি ব্যক্তিমনে বিভিন্ন ভাবের জন্ম দেয় তাদের আনন্দের ভাব হয় আবার শোকেরও ভাব হয়। 

সুতরাং বাহ্য জগতের এ বিষয়টাও কবির মনে লৌকিক  ভাবের জন্ম দেয়। এজন্য এর কোনটি সুখের আবার কোনটি দুঃখের হতে পারে। এ সকল লৌকিক ভাব ও লৌকিক কাব্যের জগতটি কবি প্রতিভার গুণে এক অলৌকিক রুপ প্রাপ্ত হয়। 

এই লৌকিক জগতের ভাব ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত হয়ে আলাদা একটা ভাবের সৃষ্টি করে বা জগৎ তৈরি করে এই জগৎ কে বলা হয় অলৌকিক মায়ার জগৎ। অতুল চন্দ্রের কাব্য জিজ্ঞাসা গ্রন্থে আছে মায়ার জগৎ সৃষ্টি করার জন্য কবি যে অবলম্বন ব্যবহার করেন, কবি যে কবিতার জগৎ তৈরি করেন সেটা আমাদের সাধারণ মানুষের মতো নয় কখনো বস্তু জগৎ নিয়ে আবার কখনো কল্পনার জগৎ নিয়ে এই কবিতা হয় যেটা লৌকিক নয়। কবিতার জগতটি সত্য ও না আবার মিথ্যা ও না। এটার বাস্তবতা আছে এটার অনুভূতি আমাদেরকে নাড়া দেয়। সুতরাং এই কাব্যের জগতকে অলৌকিক মায়ার জগৎ বলে। 

এই অলৌকিক মায়ার জগৎ কিভাবে সৃষ্টি হয় সেই সম্পর্কে অতুল চন্দ্র গুপ্ত তার কাব্য জিজ্ঞাসা গ্রন্থে বলেন, 

  " কবি যে কাব্যের মায়াজগৎ সৃষ্টি করেন তার কৌশলটি কী? এ প্রশ্নের যথার্থ উত্তর অবশ্য অসম্ভব।  কারণ এ প্রশ্ন নিখিল কবি প্রতিভার নিঃশেষ পরিচয় দাবি করা।" (অতুলচন্দ্র গুপ্ত,  কাব্যজিজ্ঞাসা, পৃষ্ঠা ২৩, সংস্করণ আষাঢ় ১৪০৯)

   একজন কবি কিভাবে অলৌকিক মায়ার জগতে কবিতা লিখেন?  কিভাবে৷ তার প্রক্তিয়া হয়? তা সব কবির ক্ষেত্রে একই রকম নয়। সুতরাং এটি যদি প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে ব্যক্তির প্রতিভার প্রতি একটি প্রাশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়। এবং এর উত্তর পাওয়া আসলে অসম্ভব। তবে সকল কাব্য সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা দেওয়া যায় সেটা হল কঙ্কালের মত কারণ মানুষের দেহের কঙ্কাল সবার একই রকম কিন্তু অবয়বের রুপ ভিন্ন ভিন্ন। 

অলংকারিকদের মতে এই লৌকিক মায়ার জগতের ০৩ টি ভাগ রয়েছে যথা - ১. বিভাব ২.অনুভাব  ৩.সঞ্চারীভাব 

  বিভাব বলতে কারণ, নিমিত্ত ও হেতু বোঝানো হয়। বিভাব সম্পর্কে আচার্য ভরত তার বিখ্যাত নাট্যশাস্ত্র গ্রন্থে বলেছেন  কারণ,  নিমিত্ত, হেতু ও বিভাব একই শব্দ।  বিশ্বনাথ কবিরাজ বিভাবকে বলেছেন, লৌকিক জগতে যা রতি ও প্রভৃতি ভাবের উদ্বোধক, কাব্যে বা নাটকে তাকেই বিভাব বলে। মনে করি, কারো পিতা মারা যাওয়ায় সে কাঁদছে।  যদি প্রশ্ন করা হয়,  কেন কাঁদছে?  উত্তর হবে পিতা মারা গেছে তাই কাঁদছে। অর্থাৎ কারণ হলো পিতা মারা যাওয়া। তাই এখানে বিভাব হল পিতা মারা যাওয়া। এই বিভাব শোককে বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং, উপরিউক্ত দুই অলংকারিকদের মতে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি যে, পাঠক বা সমাজের রতি ও প্রবৃত্তি যা ভাবের উদ্বোধক তাই ই বিভাব। বিভাব দুই প্রকার যথা ১. উদ্দীপন বিভাব  ২. আলম্বন বিভাব।

উদ্দীপন বিভাব  হল সে সকল অবস্থা বা বস্তু যা রসকে উদ্দীপিত করে অর্থাৎ রসের আনুকূল্য সৃষ্টি করে। মেঘনাদবধ কাব্যে বৈষ্ণব পদাবলীতে,

 কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।

আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।

বাঁশীর শবদেঁ মো আঊলাইলোঁ রান্ধন।।

 এখানে বিভাব হলো কৃষ্ণের প্রেম এবং উদ্দীপন বিভাব হল বাঁশির সুর। 

 আলম্বন বিভাব হলো সেই বন্তু যা অবলম্বন করে রস উৎপন্ন হয়। কৃষ্ণকে অবলম্বন করে প্রেম সৃষ্টি তাই এখানে কৃষ্ণই হলো আলম্বন বিভাব। কালিদাসের " অভিজ্ঞান শকুন্তল" নাটকে নায়িকা শকুন্তলাকে দেখে রাজা দুষ্ম্যন্তের চিত্তে রতিভাবের জাগরণ অনিবার্য হয়ে উঠলো, এখানে শকুন্তলা আলম্বন বিভাব। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শকুন্তলা রতিভাবের উদ্বোধক কারণ বা হেতু এবং নৃপতিচিত্তে প্রণয়বৃত্তিকে জাগ্রত করেছে।

'মনে ভাব উদ্বুদ্ধ হলে যেসব স্বাভাবিক বিকার ও উপায়ে তা বাইরে প্রকাশ হয়। ভাবরুপ কারণের সেইসব লৌকিক কার্য কাব্য ও নাটকের অনুভাব।'(কাব্যজিজ্ঞাসা পৃষ্ঠা - ২৪) পণ্ডিতরাজ জগন্নাথের মতে যা আলম্বন ও উদ্দীপন বিভাগের রুপ কারণ এর কার্য বলে খ্যাত তাকেই অনুভাব শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। অনু অর্থ (কারণসমূহের) পশ্চাৎ ভাব অর্থাৎ যে ভাবগুলির উৎপত্তি পরে তারা অনুভাব। যেমন কান্নাকাটি করা, বুক চাপড়ানো, মাথায় হাত ও আনন্দে লাফিয়ে ওঠা ইত্যাদি শারীরিক লক্ষণগুলি।

বিভাব অনুভাব ছাড়াও অলংকারিকগণ আরো একটি ভাবের উল্লেখ করেছেন সেটা হল সঞ্চারিভাব। এই সঞ্চারিভাব আলোচনায় যে মনোবিজ্ঞানের ওপর অলংকারিকেরা রসতত্ত্বের যে ভিত্তি গড়েছেন তার একটু বর্ণনা প্রয়োজন।

 মানুষের ইমোশন অনন্ত।  কারণ ইমোশন শুদ্ধ  feeling বা সুখদুঃখানুভূতি নয়। আধুনিক মনোবিদদের ভাষায় ইমোশন হচ্ছে একটি complete psychosis । সর্বাবয়ব মানুসিক অবস্থা। ইমোশন কতকগুলি idea বা বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে বিদ্যমান থাকে। ভাব বা ইমোশন সংখ্যাতীত এবং কোন ভাব অন্য ভাবের সম্পূর্ণ সদৃশ নয়। কিন্ত তবুও মনোবিজ্ঞানি ও অলংকারিকেরা কাজের সুবিধার জন্য অগণ্য ভাবের মধ্যে কয়েক প্রকার ভাবকে সাদৃশ্যবশত কয়েকটি সাধারণ নামে বিভক্ত করেছেন। 

অলংকারিকেরা এমন প্রধান নয়টি ভাবের কথা স্বীকার করেছেন যথা - রতি, হাস, শো,  ক্রোধ, উৎসার, ভয়, জিগুপ্সা, বিস্ময় ও নাম। এই ভাবগুলোকে স্থায়ী ভাব বলে চিন্থিত করেছেন। কেননা ভাবরুপ বহু চিত্তবৃত্তির মধ্যে যে ভাব মনে বহুলরুপে প্রতীয়মান।  অলংকারিকদের মতে এই নয়টি ভাব কাব্যের বিভাব অনুভাবের সংস্পর্শে যথাক্রমে নয়টি রসে পরিণত হয় যথা  - শৃঙ্গার,  হাস্য, করণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস,  অদ্ভুত, ও শান্ত। আলংকারিকেরা নির্বেদ,  লজ্জা, হর্ষ, অসূয়া ও বিষাদ প্রভৃতি তেত্রিশটি ভাবের নাম উল্লেখ করেছেন এবং তা ছাড়াও অনেক ভাব আছে বলে মেনে নিয়েছেন।

এই ভাবকে অলংকারিকেরা বলেছেন সঞ্চারি বা ব্যভিচারী ভাব।  কারণ তাঁদের থিয়োরি হচ্ছে,  এইসব ভাব মনে স্বতন্ত্র থাকে না, কোন না কোন স্থায়ী ভাবের সম্পর্কেই মনে যাতায়াত করে সেই স্থায়ী ভাবের অভিমুখে মনকে চালিত করে। তাই তাদের নাম সঞ্চারি বা ব্যভিচারী ভাব।

অভিনব গুপ্ত বলেছেন স্থায়ীভাবের পরিণতিই রস, বাকিগুলো সঞ্চারি।  রসের মধ্যে আবার স্থায়ী রস ও সঞ্চারী রসের এই বিভাগ যুক্তিযুক্ত নয়। এ নিয়ে অধিকাংশ অলংকারিক একই মত পোষণ করেন। কিন্তু স্থায়ী ও সঞ্চারীর প্রভেদ মূলগত প্রভেদ নয়। এবং সঞ্চারী ভাবের স্বতন্ত্র রসে পরিণতি সম্ভব নয়। সেইজন্য আলংকারিকদের মধ্যে  এই মত প্রচলিত যে,  সঞ্চারী রসই কেবল রসের পরিপুষ্টসাধক নয়। 

কাব্যে স্থায়ী ও সঞ্চারী এই ভেদটি আপেক্ষিক।  কারণ এক কাব্যপ্রবন্ধে যখন নানা রস থাকে তখন তার মধ্যে একটি রস প্রধান এবং স্থায়ী ভাবের পরিণতি অন্য রস তার পরিপোষক হয়ে সঞ্চারীর কাজ করছে। তাই আধুনিক যুগের কাব্যতাত্ত্বিকেরা স্বীকার করেন যে,  কাব্যগত মৌল চেতনার সংহতি রক্ষার জন্য একটি মাত্র রসই অঙ্গি রস হয়ে থাকে এবং অন্যগুলো সঞ্চারী বা ব্যভিচারী রস হিসেবেই আখ্যায়িত হওয়া উচিত।

সুতরাং সাধারণত এই তিন উপায়ে অলোকিক মায়ার জগৎ তৈরি করেন একজন কবি। যার মাধ্যমে বাহ্য জগতের রুপ, রস ও গন্ধ অন্তর জগৎ এর রুপ রস ও গন্ধ সহযোগে তৈরি হয় অলৌকিক মায়ার জগৎ। অলৌকিক মায়ার জগৎ আমাদের চেনা পরিচিত জগতের বাইরের এমন এক জগৎ যা না সত্য না মিথ্যা। বাহ্য জগতের সাথে কবি তার অন্তর জগতের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেন সাহিত্যের অনন্য এক জগৎ। 


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url