হৃদরোগের ধরন ও লক্ষণসমূহ!
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনবহুল রোগের নাম হচ্ছে হৃদরোগ। বিশ্বে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে বাড়ছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সারা বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে হৃদরোগের মাত্রা গত দশ পনেরো বছরের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।
সূচিপত্র
- হৃদরোগ কী
- হৃদরোগের কারণ
- হৃদরোগ এর ধরন
- হার্ট অ্যাটাক
- হার্ট ফেইলিউর
- অ্যানজাইনা
- বাংলাদেশে হৃদরোগের অবস্থান
- উপসংহার
হৃদরোগ কী?
বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষের হৃদপিন্ডে বা হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হলে যে যে সাময়িক অথবা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে হৃদরোগ বা হার্ট ডিজেস বলে। বর্তমানে বিশ্বে যতগুলো মরণব্যাধি আছে তার মধ্যে হৃদরোগ অন্যতম।
হৃদরোগের কারণ বা যে বৈশিষ্ট্যগুলো আপনার হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে!
১.ডায়াবেটিস
২.ধূমপান ও মদ্যপান
৩.উচ্চ রক্তচাপ
৪.মানসিক দুঃশ্চিন্তা
৫.রক্তে উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল যা হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
৬. বংশগত কারণ ( বাবা-মা,ভাইবোন ইত্যাদি হৃদরোগে আক্রান্ত)
৭.নারীদের থেকে পুরুষদের হৃদরোগের সম্ভাবনা বেশি।
৮. অতিরিক্ত ওজন
৯.কম পরিশ্রমী বা অলস ব্যক্তির ঝুঁকি বেশি।
হৃদরোগ বা হার্ট ডিজিসের ধরন
ব্যক্তি ও বৈশিষ্ট্য ভেদে মানুষ নানা ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। তবে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ যে ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত তা হচ্ছে-
১. হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack or Myocardial Infarction)
২.হার্ট ফেইলিউর ( Heart Failure)
৩.বুকে ব্যাথা বা অ্যানজাইনা (Angina).
১.হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack)
হার্ট অ্যাটাক কী?
বর্তমানে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যায় ভুগছেন তারমধ্যে হার্ট অ্যাটাক অন্যতম।হৃদপেশীর সুস্থতার জন্য ক্রমাগতভাবে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্তের প্রয়োজন হয় যা করোনারি ধমনী মাধ্যমে পেশি তে পৌঁছায়। চর্বি জাতীয় পদার্থ, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন প্রভৃতি করোনারি ধমনীর অন্তর গাত্রে জমা হয়ে বিভিন্ন আকৃতির প্লাক গঠন করে।সময়ের সাথে প্লাকের বহির্ভাগ ক্রমশ শক্ত হতে থাকে এবং যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন এগুলো বিদীর্ণ হয়। প্লাকের চতুর্দিকে অনুচক্রিকা জমা হয়ে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। রক্ত জমাট বাঁধার কারণে একসময় করোনারি ধমনীর লুমেন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং হৃদপেশী তে পুষ্টি ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে হৃদপেশী ধ্বংস হয়ে যায় , যে হৃদরোগকে মেডিকেল সাইন্স এর ভাষায় হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন ( মায়োকার্ডিয়াল অর্থ হৃদপেশি, আর ইনফার্কশন অর্থ অপর্যাপ্ত রক্ত প্রবাহের কারণে টিস্যুর মৃত্যু) বলে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষন
১.বুকে অস্বস্তিঃ
বুকের মাঝখানে অস্বস্তি হতে থাকে কয়েক মিনিটে ধরে, ব্যাথা চলে যায় আবার ফিরে আসে। বুকে চাপ,মোচরান, ব্যাথা অনুভূত হয়।
২.উর্ধাঙ্গের অন্যান্য অংশে অস্বস্তিঃ
বাহু, পিঠ, গল, চোয়াল, পাকস্থলীর উপরের অংশে অস্বস্তি ও ব্যথা অনুভব।
৩.ঘন ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসঃ
বুকে অস্বস্তি সময় বা অস্বস্তি হওয়ার আগে সময় ঘনঘন নিশ্বাস প্রশ্বাস ঘটে।
৪.বমি বমি ভাবঃ
বমি-বমি ভাব,বমি হওয়া,মাথা ঝিমঝিম করা,ঠান্ডা ঘাম বেরিয়ে যাওয়া।
৫.ঘুমে ব্যাঘাতঃ
ঘুমে ব্যাঘাত ঘটা,নিজেকে শক্তিহীন, ক্লান্ত বোধ করা।
প্রতিরোধ
১. হৃদরোগের সম্ভাবনা কমানোর জন্য ঋতুকালীন টাটকা ফল ও শাকসবজি খাওয়া।
২. চর্বি ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার না খাওয়া বা পরিমিত খাওয়া।কারণ চর্বি ও কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক গুন বাড়িয়ে দেয়।
৩. বডি মাস ইনডেক্স মেনে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলা। কারণ স্থুলতা হৃদরোগের অন্যতম কারণ।
৪. পরিমিত ব্যায়াম করা।এতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা হৃাস পায়।
৫. ধুমপান, মদ্যপান না করা।
৬. কোলেস্টেরল,ডায়াবেটিস,উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিও যদি এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখে,তাহলে তার মৃত্যু ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
২.হার্ট ফেইলিউর ( Heart Failure)
হার্ট ফেইলিউর কী?
হৃৎপিণ্ড যখন দেহের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত রক্তের যোগান দিতে পারে না তখন এ অবস্থাকে হার্ট ফেইলিওর বলা হয়। অনেক সময় হৃদপিন্ড রক্তে পরিপূর্ণ হতে না পারায়, কখনোবা হৃৎ-প্রাচীরে যথেষ্ট শক্তি না থাকায় হৃৎপিন্ডের এমন অবস্থা হতে পারে। এটি একটি মারাত্মক হৃদরোগ যা সঠিক সময়ে বুঝতে না পারলে এবং চিকিৎসা না নিলে প্রাণঘাতি হতে পারে।
হার্ট ফেইলিওর এর কারণ
হৃৎপিন্ডের করোনারি ধমনী অন্তঃস্থ গাত্রে কোলেস্টেরল জমে ধমনীর গহবর সংকীর্ণ হলে হৃদ- প্রাচীরে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়।কালান্তরে হার্ট ফেলিওর ঘটে। উচ্চ রক্তচাপ বেশি দিন স্থায়ী হলে ধমনীর অন্তঃস্থ প্রাচীরে কোলেস্টেরল জমতে থাকে ফলে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং হৃৎপিণ্ড ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। ডায়াবেটিস এর ফলে ও দেহ পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন বা সঠিকভাবে ব্যবহারে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।এ কারণে ধীরে ধীরে হৃদপেশি ও হৃৎপিন্ডের বাহিকা গুলো দুর্বল হতে থাকে ফলে হার্ট ফেলিওর ঘটে। তবে হৃৎপিণ্ডে জন্মগত ত্রুটির কারনেও হার্ট ফেলিওর এর মতো হৃদরোগ দেখা দিতে পারে।
হার্ট ফেইলিওর এর লক্ষণ
১. সক্রিয়,নিষ্ক্রিয়, কখনো ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টে ভোগা এবং এই হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা ঘুমের সময় মাথার নিচে দুটি বালিশ না দিলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া।
২. সাদা বা গোলাপি রঙের রক্তমাখানো মিউকাসসহ স্থায়ী কাশি। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় জোরে শব্দ হওয়া।
৩. শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টিস্যুতে তরল জমে ফুলে ওঠা।
৪. পা, গোড়ালি, পায়ের পাতা,উদর ও যকৃত স্ফীত হয়ে যাওয়া, জুতা পড়লে হঠাৎ আঁটসাট মনে হওয়া ও অস্বস্তি বোধ হওয়া।
৫. প্রতিদিন সবসময় সবকাজে ক্লান্তি ভাব আসা।
৬. পাকস্থলী সব সময় ভরা মনে হওয়া, মাঝেমাঝে বমি বমি ভাব হওয়া।
৭. হৃদপিণ্ডের হৃদস্পন্দন অনেক দ্রুত হওয়া।
৮. কাজকর্ম, চলনে অসামঞ্জস্যতা এবং স্মৃতিহীনতা দেখা দেয়।
হার্ট ফেইলিউরের প্রতিকার
১. জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন
এই হৃদরোগ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত এবং নিয়মিত খাবার খাওয়া, চিকিৎসক এর পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যতালিকা মেনে নিয়মিত সুষম খাবার খাওয়া।
২. ওষধ গ্রহণ
হৃদরোগের উপসর্গ ও অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষধ গ্রহণ করা।
৩. অন্যান্য চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া
হার্ট ফেইলিউর যাতে খারাপের দিকে মোড় না নেয় সেদিকে লক্ষ রাখা।শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম করা।যে রোগ গুলো হৃৎপিন্ডের ঝুঁকি বাড়ায় সেগুলো কে সবসময় নিয়ন্ত্রণে রাখা। যাতে এই হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৩. অ্যানজাইনা
অ্যানজাইনা কী?
হৃৎপিন্ডের হৃৎপেশি যখন অক্সিজেন সমৃদ্ধ পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ পায় না তখন বুকে নিষ্পেষিত হচ্ছে অথবা দম বন্ধ হয়ে আসছে এমন অনুভূত হলে সে ধরনের বুক ব্যাথাকে অ্যানজাইনা বলে।অ্যানজাইনাকে স্বাভাবিকভাবে হার্ট অ্যাটাক এর পূর্বাবস্থা মনে করা হয়।
অ্যানজাইনার লক্ষণ
১. উরঃফলক বা স্টার্নামের পিছনে বুকে ব্যাথা হওয়া। ব্যাথা ৫- ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়।
২. অ্যানজাইনার কারণে গলা, কাঁধ,চোয়াল, বাহু, পিঠ বা দাঁতেও ব্যাথা ছড়াইতে পারে।
৩. বুকে জ্বালাপোড়া, চাপ,নিষ্পেষণ ইত্যাদি ভাব অনুভুত হওয়াও ঘাম হওয়া।
৪. হজমে সমস্যা ও বমি বমি ভাব হতে পারে। মাথা ঝিমঝিম করা।
৫. ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া,দম ফুরিয়ে আসা এমন অনুভব করা।
প্রতিরোধ
হৃদরোগ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা ও অ্যানজাইনা প্রতিরোধের জন্য -
১. হাঁটাচলা বা নিয়মিত ব্যায়াম করা।
২. স্থুলতা প্রতিরোধ করা।
৩. সুষম বা হৃৎবান্ধব খাবার খাওয়া।
৪. রক্তচাপ, কোলেস্টেরল,ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাহলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।
৫. ধুমপান ও মদপান থেকে বিরত থাকা।এতে হৃদরোগ এর পাশাপাশি পাকস্থলী ও ফুসফুসের নানারকম রোগ থেকে ও সুরক্ষিত থাকা যায়।
বাংলাদেশে হৃৎরোগের অবস্থান
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় উঠে এসেছে, বর্তমানে আমাদের দেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ২০-২৫ শতাংশ মানুষ। করোনারি বা ইস্কিমিক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী শতকরা ১০ ভাগ।বাতজ্বর জনীত কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি হাজারে ১.২ জন।এছাড়া প্রতিহাজারে ৮ জন নবজাতক জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গবেষণায় হৃৎরোগে আক্রান্ত রোগীর হার বেড়ে যাওয়ার জন্য স্বল্প পরিশ্রম কে দ্বায়ী করা হয়েছে।জীবন যাত্রার মান বদলে যাওয়ায় গ্রাম ও শহর উভয়ে বসবাসকারী মানুষের জীবনে এসেছে বিপুল পরিবর্তন যার কারণে পরিশ্রম কমে গেছে। আর একেই হৃদরোগের মূল কারণ হিসেবে দাবী করেছেন।
উপসংহার
হৃৎপিন্ড মানবদেহের মূল রক্ত সংবহনতন্ত্র হিসেবে কাজ করে। হৃৎপিন্ড সারাদেহে রক্ত পাম্প করে। আর বর্তমান সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যুহার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে।তাই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা এবং হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য সচেতনতার বিকল্প নেয়।তাই সুস্থ জীবনযাপনের জন্য ও হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস করার জন্য আমাদের নিয়মিত ব্যায়াম বা পরিশ্রম,সুষম খাদ্য গ্রহণ ও নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমানোর অভ্যাস তৈরী করতে উচিৎ ।
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url