রাত জাগলে কী ক্ষতি হয়?
ঘুম মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়।পর্যাপ্ত ঘুম একটি সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন চলমান রাখার নিয়ামকরুপে কাজ করে। এদিকে বর্তমান সময়ে প্রায় সবারই একটা বদঅভ্যাস লক্ষ করা যায়।তা হলো নিয়মিত রাত জাগা বা অপর্যাপ্ত ঘুমানো। রাত জাগা শরীরের পাশাপাশি মনের ওপরে বিরুপ প্রভাব ফেলছে।যা ক্রমশ নানারকম শারীরিক ও মানসিক রোগের সৃষ্টি করছে।
মস্তিষ্ক বা ব্রেইন
রাত জাগার ফলে ব্রেইন যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
মানবদেহের সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু মস্তিষ্ক বা ব্রেইন। রাত জাগলে বা অপর্যাপ্ত ঘুম ব্রেইনের যে কার্যক্রমের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে বা ক্ষতি করে তা হচ্ছে স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগ। নিয়মিত রাত জাগলে স্মৃতিশক্তির ক্ষতি সাধন হয় বা ক্রমশ কমতে থাকে। রাত জাগার ফলে বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা হৃাস পেতে থাকে ।তার সাথে মস্তিষ্কে কোন কিছুর ওপর মনোনিবেশ ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। তাই মস্তিষ্কের সঠিক ও সুষম কার্য সম্পাদনের জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। মস্তিষ্কের কার্যক্রম সঠিকভাবে অব্যাহত রাখার জন্য রাত জাগা পরিহার করা উচিৎ।
হৃদপিণ্ড বা হার্ট
রাত জাগার ফলে হৃদপিণ্ড যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
হৃদপিণ্ড মানব দেহের মুল রক্ত সংবহনতন্ত্র। এটি সারা দেহে অবিরাম রক্ত পাম্প করে। নিয়মিত ঘুমের সাথে হার্ট এর সুস্থতার সম্পর্ক রয়েছে। রাত জাগার কারণে হার্ট এর কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। দীর্ঘদিন রাত জাগার ফলে হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির আশংকা বাড়তে থাকে। তাই,হার্ট বা হৃদপিন্ডের সুস্থতার জন্য নিয়মিত ঘুমের কোনো বিকল্প নেয়।
ফুসফুস
রাত জাগার ফলে ফুসফুস যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
ঘুমের সময় আমাদের শ্বাসক্রিয়া সুষম ও গভীরভাবে চলতে থাকে। দীর্ঘদিন রাত জাগার ফলে ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রম ক্ষতি গ্রস্থ হতে থাকে। ফলে দিনদিন ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তাই রাত জাগলে ফুসফুসের মারাত্বক ক্ষতি সাধন হয়।
পাকস্থলী বা স্টমাচ
রাত জাগার ফলে পাকস্থলী যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
আমাদের পাকস্থলীতে অবিরাম তীব্র HCl(হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড) নিঃসৃত হয়।পাকস্থলীর উপরে মিউক্যাসল লেয়ার নামের একটি স্তর থাকে যার ফলে তীব্র এসিড এর উপস্থিতিতেও পাকস্থলী গলে যায় না।অবিরত এসিড নিঃসরণ এর ফলে পাকস্থলীতে যে অবস্থা সৃষ্টি হয় তা ঘুম বা বিশ্রামের সময় নিউক্যাসল লেয়ার এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা যখন রাত জাগি তখন তা সম্ভব হয় না।আর দীর্ঘদিন এই অবস্থা অব্যাহত থাকার ফলে পাকস্থলীতে এসিড নিঃসরণের জন্য গ্যাস্ট্রিক বা আলসারের সৃষ্টি হয়ে পাকস্থলীর ক্ষতি হয়।
যকৃত বা লিভার
রাত জাগার ফলে যকৃত যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
দেরি করে ঘুমাতে যাওয়া ও দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা দুটোই লিভারের জন্য ক্ষতিকর। অনেক দিন যাবত রাত জাগার এই অভ্যাসের ফলে খাবার হজমে সমস্যা দেখা দেয়। রাত জাগলে এবং সকালে দীর্ঘক্ষন না খেয়ে থাকার অভ্যাস ও অনিয়ম চলতে থাকলে লিভার বা যকৃত ক্রমশ কার্য ক্ষমতা হারাতে থাকে। এবং যকৃতের ওপর বিরূপ প্রভাব পরে।
বৃক্ক বা কিডনি
রাত জাগার ফলে বৃক্ক যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
বৃক্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে বৃক্ক বা কিডনি।নিয়মিত রাত জেগে থাকা ও অনিয়মিত ঘুমানোর ফলে কিডনির কর্মক্ষমতা কমে যায়। নিয়মিত রাত জাগার অভ্যাস কিডনি বিকল হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ামক বা প্রভাবকরুপে কাজ করে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে থাকে।
চোখ
রাত জাগার ফলে চোখ যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
চোখ মানবদেহের একটি সেনসিটিভ অঙ্গ পঞ্চ ইন্দ্রিয় এর মধ্যে একটি। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রাত জাগার ফলে নানারকম চোখের সমস্যা দেখা দেয়।চোখের দৃষ্টিশক্তি কমতে থাকে। এছাড়া চোখের EP(আই প্রেশার) এর স্বাভাবিক মাত্রা বিঘ্নিত হতে থাকে।
রাত জাগা, অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত ঘুমানোর ফলে আপনি মানসিকভাবে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন!
নিয়মিত রাত জাগার ফলে আপনার মন যেভাবে প্রভাবিত হচ্ছে-
আমাদের দেশে একটি প্রচলিত প্রাবাদ বাক্য আছে," সুস্থ দেহে, সুস্থ মন!"শরীর বা মনের সুস্থতা একে অপরকে প্রভাবিত করে। সুস্থ শরীর ছাড়া সুস্থ মন কল্পনা করা যায় না।আর রাত জাগা,অনিয়মিত ঘুম যেহেতু শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্নিত করে,তাই মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ করে।
রাত জাগা বর্তমান সময়ে একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। নিয়মিত রাত জাগার ফলে মানসিক অবসাদ, তীব্র হতাশা, দুঃশ্চিন্তা দেখা দেয়।যারা নিয়মিত রাত জাগে,তাদের মধ্যে মেজাজ খিটখিটে ও আলস্য ভাব দেখা দেয়,সবকিছুতে অনিহা বোধ করে। কোনো কাজে একান্তভাবে মননিবেশ করতে পারে না।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কম ঘুমে অভ্যস্ত ব্যাক্তিদের মানসিক অবসাদের কারণে এদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবনতা সবচেয়ে বেশি।তাই সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেয়।
বয়সভেদে আপনার কত ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপ ফাউন্ডেশন(NSF) এর মতে,একজন মানুষের সুস্থ শরীর ও মন পরিচালনার জন্য বয়সভেদে যত ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন তা নিন্মরুপ-
শিশুদের ক্ষেত্রে,
০-৩ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেঃ ১৪-১৭ ঘন্টা (তবে ১৯ ঘন্টার বেশি হওয়া উচিৎ না)
৪ -১১ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেঃ ১০-১৮ ঘন্টা,
১-২ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেঃ ১১-১৪ ঘন্টা,
৩-৫ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ ১০-১৩ ঘন্টা,
৬-১৩ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ ৯-১০ ঘন্টা,
১৪-১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ ৮-১০ ঘন্টা,
১৮-২৫ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ ৭-৯ ঘন্টা,
২৬-৬৪ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ ৭-৯ ঘন্টা,
৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রেঃ৭/৮ ঘন্টা ( তবে ৫ ঘন্টার কম বা ৯ ঘন্টার বেশি হওয়া উচিৎ না)
দীর্ঘদিন ধরে রাত জাগা ও অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস আমাদের দেহের বায়োলজিক্যাল ক্লক এর কার্যনীতি পরিবর্তন করে দেয়।একটি সুস্থ শরীর ও সুস্থ মনের জন্য সুষম খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম খুবই প্রয়োজন। আর উভয় সুস্থতা বজায় রাখা বা অর্জনের জন্য আমাদের " আরলি বেড,আরলি রাইজ" নীতি মেনে চলা উত্তম।নাহলে রাত জাগার অভ্যাস আমাদের মৃত্যির দোয়ারে পৌছে দিবে।
এজন্য আমাদের দিনে ঘুম পরিহার করা এবং রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস তৈরী করা উচিৎ। ঘুমানোর আগে মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ জাতীয় ডিভাইস ব্যবহার না করা উত্তম যাতে ঘুমাতে দেরি না হয়।
সকলের সুস্থতা কামনা করি!
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url