নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ নিয়ে কাজী আবদুল ওদুদের মতামত
১. কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ অবলম্বনে কাজী আবদুল ওদুদের মতামত
২. কিন্তু তিনি কবি যত বড় তার চেয়েও বড় তিনি যুগ মানব
মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
‘শাশ্বত বঙ্গ’(১৯৫১) গ্রন্থের অন্যতম একটি প্রবন্ধ ‘নজরুল ইসলাম’ যেখানে আবদুল ওদুদ নজরুলের বিদ্রোহী ও সৃষ্টিমত্তাকে তীক্ষ্ণভাবে মূল্যায়ন করেছেন। প্রবন্ধে নজরুলের সাহিত্য জীবনকে তিনি চারটি স্তরে ভাগ করেছেন-
১.সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে বিদ্রোহী প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত।
২.বিদ্রোহী প্রকাশের পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবস্থান পর্যন্ত।
৩. সংগীত ও গজল রচনার যুগ।
৪. নজরুলের যোগী জীবন।
চতুর্থ স্তরকে ‘যোগী জীবন’ নামে অভিহিত করে সাহিত্যের প্রতি নজরুলের আত্মসমর্পণ চিত্ততাকে ও ওদুদ স্পষ্টায়িত করেছেন। প্রবন্ধটি কোভিদ ৪৩ তম জন্মোৎসবে ১৩৪৮ সালে পঠিত হয়েছে। সমালোচকের মতে-
“বাংলাদেশের এ যুগের দু'জন মুসলমান লেখক দেশের ঐতিহ্য ও সাধনাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছেন- জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ, এবং সহজাত প্রেরণা এবং আবেগ দিয়ে নজরুল ইসলাম।” (পৃ. ৮৬, ওদুদ-চর্চা, ড. সাঈদ-উর রহমান, প্রকাশ সাল নেই)
কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ অবলম্বনে কাজী আবদুল ওদুদের মতামত
শ্বাশ্বত বঙ্গের অন্তর্গত ‘'নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে আবদুল ওদুদ নজরুলের সাহিত্য ও মননশীলতার বিশ্লেষণ করেছেন। নজরুলের সাহিত্য সৃষ্টির সময়গুলোকে ৪ স্তরে ভাগ করে প্রতিটা স্তরে নিজের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করেছেন। প্রাবন্ধিকের মতে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পূর্বেই তার নবীনতা অথবা উদ্দামতা, আর ছন্দ-সামর্থ্যের প্রতি বাংলার সাহিত্যিকরা আকৃষ্ট হয়। বিদ্রোহী পূর্ব যুগে নজরুল মানসে ওদুদ লক্ষ্য করেছেন কবির দায়িত্বহীন ভবঘুরে জীবনের বিলাস, অভিমান এবং ব্যর্থ প্রেমের আর্তি জনিত করূণ্য। প্রাবন্ধিকের মতে, এ পর্যায়ে নজরুল আকৃষ্ট হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তার যৌবনের প্রেম সঙ্গীতে, সত্যেন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে এবং ইরানের কবি তিলক হাফিজের প্রেমের উন্মাদনায়। ‘'বিদ্রোহী’’ রচনার যুগ কবির সাহিত্যিক জীবন এবং মানস পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
“বিদ্রোহী কবিতাতেও দেখা যাচ্ছে, একদিকে তিনি যেমন নিজের ভেতরে অনুভব করেছেন সাইক্লোনের শক্তি, অন্যদিকে তেমনি তিনি মুগ্ধ চপল মেয়ের কাঁকন চুরির কণকনে'র ছলনায়।.. তার সাম্যবাদ প্রচার আর বেপরোয়া শিকল ভাঙার গানের কথা যাদের মনে আছে তারা স্মরণ করতে পারেন- প্রচন্ড ধূমকেতুর মতো কি এক ভীষণ মনোহর জীবন কবির ভিতরে সূচিত হয়েছিল।” (নজরুল ইসলাম, শ্বাশ্বত বঙ্গ)
কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ অবলম্বনে কাজী আবদুল ওদুদের মতামত
প্রাবন্ধিকের মতে, নজরুল খেলাফত যুগের প্রতিনিধি স্থানীয় কবি। তারপর যখন তিনি ‘বিদ্রোহী’ রচনা করলেন তখন তার মানসিক কুয়াশা এতখানি কেটে যায় যে, তিনি নতুন জীবন নিয়ে জেগে উঠেছেন, নিজেকে এবং জগৎকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করেছেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যুগের সাহিত্যে প্রাণশক্তির ছাপ বিদ্যমান।
আবদুল ওদুদ তাঁর ‘নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে একজন সাহিত্য রসিকের সাহিত্য বিষয়ক সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘literature is a journalism that lasts’ অর্থাৎ যে সাংবাদিকতা টিকে যায় তার নাম সাহিত্য। সাংবাদিকতা স্থায়ী হয় না কারণ তা প্রতিদিনের জীবনের মত অস্থির, অপূর্ণাঙ্গ নিয়ত পরিবর্তনশীল, কিন্তু সাহিত্য অনেকখানি অঞ্চল, পূর্ণাঙ্গ এবং কল্পনালোক এবং সৌন্দর্যলোকে তার অধিষ্ঠান। কিন্তু ওদুদ নজরুলকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন-
…. কল্পনালোকে বা সৌন্দর্যলোকে প্রতিষ্ঠিত হবার অবসর যেন নজরুলের নেই, রুচিও যেন তাতে তার নেই- প্রতিদিনের জীবনের তাড়নায় তীব্রভাবে তাড়িত হয়েই তিনি চলেছেন, আর এই তাড়নাভোগে তার যেন গভীর আনন্দ.. (নজরুল ইসলাম)
কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ অবলম্বনে কাজী আবদুল ওদুদের মতামত
প্রাবন্ধিক মনে করেন নজরুলের এই প্রাত্যহিক তাড়না এবং কাব্য সৃষ্টির পিছনে ব্রিটিশ উপনিবেশের সামাজিক রাজনৈতিক ও পরিপ্রেক্ষিত তো ছিলই, সেই সঙ্গে শৈল্পিক দৃষ্টান্ত ও ছিল। অর্থাৎ সাহিত্য সৃষ্টির উপাদান হিসেবে তিনি সব বিষয়গুলোকেই শনাক্ত করেছেন।
আবদুল ওদুদ নজরুল বিবেচনায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তার সৃষ্টিশীলতার তাত্ত্বিক সূত্র উন্মোচন করেছেন। প্রাবন্ধিকের মতে, নজরুলের যে চমৎকার তারুণ্য, জীবনকে যেভাবে তিনি সহজভাবে অনুভব করেছেন , এবং তার ভিতরের যে তাত্ত্বিক ভাবনা এগুলো সবই তার জন্মগত এবং প্রাবন্ধিক এই তত্ত্বের নাম দিয়েছেন লীলাবাদ বা Pantheism ।
“এই লীলাবাদ তার জন্য এক ধরনের আত্মবিস্মৃতি এনে দিয়েছে তাকে আশ্চর্যভাবে নিরহংকার ও সৌন্দর্যপিপাসু করেছে…”
হিন্দু চিন্তা এবং সুফি চিন্তার ও মূল কথা ‘অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টতাদ্বৈতবাদ’ - এই মতবাদের উপর নজরুল বিশ্বাস স্থাপন করে নিজের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মাথা ভাঙ্গাভাঙ্গির দিনেও অবলীলাক্রমে শ্যামাসংগীত ও বৃন্দাবন গাথা রচনা করেছেন।
প্রাবন্ধিকের মতে, নজরুল ইসলাম খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী রূপে, কিন্তু জনপ্রিয় হলেন প্রেম সঙ্গীতের রচয়িতারূপে। বাংলা সাহিত্যে বৃহত্তর জীবন সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে কিন্তু তা জমে ওঠেনি পুরোপুরি। মধুসূদন দত্তের বীররস, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথের বীররস, করুণরস, চন্ডীদাসের অমর বিরহ-গাথা সবকিছুই যেন সার্থকতার ধাপে অনুপাত হিসেবে শেষ পর্যন্ত বাঙালির অবলম্বন হয়েছে তার নগণ্য গৃহ ,তার ছোট-বড় নদী, সবুজ গাছপালা, ফসল, ক্ষেত, আর নীল আকাশ ও প্রেমময় নারী। বাংলার যে এই আবহমান প্রাণধারা তার সঙ্গে নজরুলের যোগ আশ্চর্যভাবে নিবিড়।
সুতরাং বলা যায়,
“.. কবি তিনি নিঃস্দেহে - অনুভূতির গোপন আয়োজন তার জগতে কখনো কখনো ঘটায় বাণীর অপূর্ব-দীপ্তি কিন্তু কবি তিনি যত বড় তার চাইতেও বড় তিনি যুগ-মানব।” (নজরুল ইসলাম)
যুগের বেদনা এবং উন্মাদনা তার সাহিত্যে এত প্রবল যে কবির কল্পনালোকের অবস্থানও সেখানে দুঃসাধ্য-
“কবির সৃষ্টি আকাশ কুসুম নয় কখনো, কবির কাব্য ফুল, মাটির গাছেরই ফুল। অন্য কথায় যুগ ধর্মের বেদনায় কবির মানস লালিত ও গঠিত…” (নজরুল ইসলাম)
নজরুল ইসলামকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রাবন্ধিক বলেছেন, ইসলামী সংগীত, শ্যামা সংগীত, বৈষ্ণব সংগীত এই ৩ ধারার রচনাতে তিনি সিদ্ধহস্ত হলেও শ্যামা সংগীত রচনায় তার সার্থকতা বেশি। এইসব সংগীতের ভেতর দিয়েই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের চিত্তে তিনি প্রবেশ করেছেন। প্রেম সংগীত রচনা করতে গিয়ে তার ‘বাঁধনহারা’ পত্রউপন্যাসে প্রথম জীবনে যে ব্যর্থ প্রেমের ছবি তিনি অংকন করেছেন সেটি তার সারা জীবনের ধোয়া। তার প্রেম যেমন রাধিকার তনু-মন-ধণ-জীবন-যৌবন তব পায়ে সমর্পণের প্রেম নয়, তার বিরহও তেমনি রাধিকার বুক ভাঙ্গা বিরহ নয়।
কবিরা নিঃসঙ্গ ব্যাক্তি নন তারা সমাজ এবং জাতির প্রতিনিধি। প্রাবন্ধিকের মতে, নজরুল এ যুগের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন। যেমন-
- জড়তার বিরুদ্ধে বারবার সংগ্রাম ঘোষণা করে।
- নির্যাতিত জনসাধারণের পক্ষে সমর্থন করে।
- মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের মনে নব নব আশা উদ্দিপনা সঞ্চার করে।
- বাংলার বা ভারতের আবহমান প্রান ধারার সঙ্গে প্রেমের নিবিড় যোগ স্থাপন করার আহ্বান জানিয়ে।
নজরুল তার সাহিত্যজীবন ও ব্যক্তিজীবন সর্বত্রই যুগকে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। প্রাবন্ধিকের মতে, নজরুলের এই সমকালীন চেতনা, বিদ্রোহী চেতনা হঠাৎ আবির্ভূত হয়নি এবং তা বাংলা সাহিত্যের কোন আগন্তিক সৃষ্টি নয়। মুসলিম সুফি চিন্তার মরমীভাবনাসহ সর্বেশ্বরবাদী চেতনা, তৌহিদ বা এক আল্লাহবাদী মতবাদে নজরুল যে সমর্পিত ছিলেন তা ওদুদ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। নজরুল যুগপৎ সমাজ সচেতন এবং প্রেম ও বিরহমুলক কাব্যে সচেতন শিল্পরুচির পরিচয় দিয়েছেন। জীবনের ভুল-ভ্রান্তি ও ভোগ-দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে জীবনকে অতিক্রান্ত করলেও জীবনকে সুষমাময় চমৎকারিত্ব ও বিশ্বাসবোধের ব্যাপকতার ঐশ্বর্যের মধ্যে নজরুল ওয়ার্ল্ড হুইটম্যান ও রবীন্দ্রনাথের মতো অনুভব করেছেন বলে প্রবন্ধীক মনে করেন।
নজরুলের শিল্প সাধনার মূলে প্রাবন্ধিক লক্ষ্য করেছেন প্রেম সাধনা- যে প্রেম সব মানুষকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেশ ও জাতির প্রতি তার যে পূর্ণ প্রেম, যে আত্মনিবেদন, তা একালে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তাকে সম্মানিত স্থানে নিয়ে যায়। এবং যে বৃহৎ জীবন এবং জাতীয় জীবনের চেতনা দেশে অনুভূত হয়েছে তাতে নজরুল ইসলামের স্পর্শ লেগেছে বলে প্রাবন্ধিক মনে করেন।
মোঃ আব্দুল আল মামুন, বাংলা বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , ০১৭৮৯ ৬৯৯ ৫০৯
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url