কাজী আবদুল ওদুদের জীবনী - সাঈদ-উর-রহমান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কিছুকালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে-সাধারণ্যে সেটা পরিচিত ছিল ‘শিখা'র আন্দোলন বা বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন নামে। সংগঠনের নাম ছিল মুসলিম সাহিত্য সমাজ, 'শিখা' ছিল মুখপত্রের নাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আবুল হুসেন (১৮৯৭-১৯৩৮), ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ(১৮৯৪-১৯৭০) ও আরো কতিপয় তরুণ ছিলেন এর উদ্যোক্তা। তাঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল প্রধানত মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ, তবে অন্য সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবীরাও মাঝে মাঝে সংগঠনের কর্মধারায় অংশ নিতেন। আলোচনা-অনুষ্ঠান, পত্রিকাপ্রকাশ ও গতানুগতিকতা-বিরোধী বক্তব্য দ্বারা তাঁরা কিছুকালের জন্য হলেও সেকালের মুসলিম সমাজে আলোড়ন জাগাতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিরুদ্ধ পরিবেশের চাপে ও পেশাগত কারণে অনেকে ঢাকা ত্যাগ করায় কয়েক বছরের মধ্যে আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যক্তিগত সাধনায় অনেকে ঐ প্রেরণাকে এগিয়ে নিয়ে যান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিভ্রান্তিকর পরিবেশে 'শিখা'র প্রভাব ক্রমশঃ উজ্জ্বলতর হয় এবং প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের কাছে আন্দোলনটি তাৎপর্যবহ ঐতিহ্যে পরিণতি লাভ করে। কাজী আবদুল ওদুদের ব্যক্তিগত আদর্শানুরক্তিও তাঁদের সশ্রদ্ধ মনোযোগ আকর্ষণ করে। জাগতিক অনেক উন্নতির সম্ভাবনা ও প্রলোভন সত্ত্বেও দেশবিভাগের পর তিনি কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকা আসতে রাজী হননি এবং আত্মীয়-স্বজনহীন পরিবেশে সেখানে পরলোকগমন করেন ১৯৭০ সালে। জীবন ও আদর্শের এই সমন্বয় পঞ্চাশ-ষাট দশকের বাঙালী মুসলমান সমাজে ছিল প্রায় দুর্লভ ঘটনা। ফলে জীবিত অবস্থাতেই পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীদের
(পৃষ্ঠা-৫)
মনে তিনি উঁচু আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগে-পরে ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। সেগুলোতে প্রাবন্ধিকেরা তাঁকে স্মরণ ও মূল্যায়ন করেছেন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর স্বভাবতই সে-আগ্রহ ব্যাপকতর হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর রচনাবলী পাঠ্য হয়েছে, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে গবেষণা শুরু হয়েছে। ১৯৮২ সালে একজন গবেষক মুসলিম সাহিত্য সমাজ সম্পর্কে গবেষণা করে পি. এইচ. ডি. লাভ করেছেন। এই নবজাগ্রত কৌতূহলই আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে বর্তমান সংকলনের পরিকল্পনায়। সরলভাবে বলতে গেলে আমাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ওদুদ-চর্চার প্রয়াসকে সমন্বিত করা ও শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটানো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ওদুদ-এর রচনাবলী পাঠ্য হলেও কোনো সমালোচনাগ্রন্থ, এমনকি মূল রচনাও, ছাত্রদের কাছে সুলভ নয়। সেই অভাব মোচনের লক্ষ্যে এই সংকলন একটি পদক্ষেপ মাত্র।
২
১৮৯৪ সালের ২৬-এ এপ্রিল (১৩০১ সালের ১৪ই বৈশাখ) শুক্র-বার ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার অন্তর্গত বাগমারা গ্রামে কাজী আবদুল ওদুদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী সৈয়দ হোসেন ওরফে কাজী সগীরউদ্দীন ছিলেন দরিদ্র চাষী ও মাইনর-পাশ। বাগ-মারার কাজীদের আভিজাত্য-গৌরব ছিল।
ওদুদের নানা পাঁচমোল্লার বাড়ি ছিল বাগমারা থেকে তিন মাইল দূরবর্তী পদ্মাতীরের হোগলা গ্রামে। তিনি সম্পন্ন জোতদার ছিলেন ও লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝতেন। তাঁর ছেলেদের দুইজন ছিলেন পুলিশের দারোগা ও একজন ছিলেন শিক্ষাবিভাগের সহকারী ইন্সপেক্টর। ওদুদ সাহেবের এক দাদা এদের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করতেন এবং সে-সূত্রে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। সে-ঘনিষ্ঠতা গড়ায় সগীর কাজীর সঙ্গে পাঁচুমোল্লার সুন্দরী কনিষ্ঠা কন্যার বিয়েতে--বিত্ত-বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হয় শরাফতী। নতুন আত্মীয়রা তাঁকে ইষ্ট বেঙ্গল রেলওয়েতে চাকুরীর ব্যবস্থা করে দেন। তিনি হাওড়ার স্টেশনমাষ্টার থাকাকালীন অবস্থায়
(পৃষ্ঠা - ৬)
মৃত্যুমুখে পতিত হন। জগন্নাথপুর মাইনর স্কুলে ওদুদের পাঠ শুরু হয়। সেখান থেকে ছোট দারোগা মামার সাথে ঢাকা, নরসিংদী, পাবনা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলে লেখাপড়া করে ১৯১৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রিয় বিষয় 'বাংলায় যথেষ্ট কম নম্বর' পাওয়ায় তিনি পরীক্ষায় আশানুররূপ ভাল করতে পারেননি, তবে দশ টাকার একটি জেলা বৃত্তি পেয়েছিলেন।
অতঃপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজে। তিনি বি. এ. পাশ করেন ১৯১৭ সালে এবং দু-বছর পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল ইকোনোমিতে এম. এ. পাশ করেন। কিন্তু তাঁর কর্মজীবন আরম্ভ হয় সাহিত্যের অধ্যাপকরূপে, ১৯২০ সাল থেকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে। ছাত্রজীবনে তিনি সাহিত্যানু-রাগী ছিলেন এবং সে-সময়েই দু-একটি গল্প, একটি উপন্যাস ও কয়েকটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ রচনা করে খ্যাতিলাভ করেন। সে সুবাদে, বাংলা সাহিত্যে প্রয়োজনীয় ডিগ্রি না-থাকা সত্বেও, সর্বো-পরি তখনো কোনো মুসলমান যুবক সাহিত্যে এম. এ. পাশ না-করায়, মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ঐ পদে তিনি মনোনয়ন পান। দীর্ঘদিন এখানে কাজ করার পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি টেক্সট বুক কমিটির সেক্রেটারী পদে নিযুক্ত হয়ে কলকাতা গমন করেন। যুদ্ধের সময় অফিস কিছুকালের জন্য রাজশাহীতে স্থানান্ত-রিত হয়েছিল, সঙ্গে এসেছিলেন কাজী সাহেবও।
দেশবিভাগের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করার কথা তাঁকে বলা হয়েছিল, কিন্তু সাহিত্যচর্চার পরিবেশ অধিকতর অনুকূল বিধায়, বিশেষত তাঁর আবাল্য স্বপ্ন মহাপুরুষদের সম্পর্কে গবেষণা করার সুযোগ কলকাতায় বেশী থাকায়, তিনি সেখানে থেকে যান। এই সংকল্প সুসম্পন্ন করে ঢাকায় আসবেন, এমন ইচ্ছা তাঁর ছিল বলে শোনা যায়, কিন্তু ইতিমধ্যে প্রিয়তমা স্ত্রী জমিলা খাতুনের মৃত্যু (১৯৫৫) তাঁর ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটায় এবং স্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে বাকি জীবন কাটাতে তিনি মনস্থ করেন। জীবনের কর্তব্য সুসম্পন্ন করার পর শান্ত মনে তিনি তখন পরপারের আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ঐ সময়টি তাঁর অতিবাহিত হয়েছে কোরানের অনুবাদে ও নিজের সাধনা
(পৃষ্ঠা - ৭)
লব্ধ অধ্যাত্ম উপলব্ধির অনুধ্যানে। কিন্তু দুই বঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি, পাকিস্তান-ভারতের সংঘর্ষ তাঁকে বিচলিত করে ও দুরা-রোগ্য পারকিনসন রোগের জ্যা দেয়। জীবনের গোধূলি বেলায়, বন্ধুদের অনুরোধে, তিনি আত্মচরিত রচনা শুরু করেছিলেন, কিন্তু সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। এই একটি কাজ অসম্পূর্ণ রেখে, ১৯৭০ সালের ১৯-এ মে তিনি মহাপ্রয়াণে যাত্রা করেন। মৃত্যুকালে শয্যাপায়ে তাঁর কোন আত্মীয়-স্বজন ছিলেন না। ঢাকা থেকে তাঁর একমাত্র কন্যা জেবুন্নেসা উপস্থিত হয়ে ছিলেন মাত্র পঁচিশ মিনিট পরে। একদল ধর্মপ্রাণ লোক কলকাতার রাস্তায় তাকে দেরী করিয়ে দিয়ে-ছিল কালীপুজার চাঁদার জন্যে!
৩
ডক্টর ওয়াকিল আহমদ-রচিত 'মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' সংকলনের প্রথম প্রবন্ধ। তিনি সাহিত্য-সমাজ সম্পর্কিত তথ্য ও এর গঠনকালের সাংস্কৃতিক পটভূমি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন বার্ষিক সম্মেলন ও সাধারণ অধিবেশনের কার্যাবলীর প্রয়োজনীয় বিবরণও এতে পাওয়া যাবে। সাহিত্য-সমাজ টিকে ছিল দশবছর: ১৯২৬-৩৬। এই সময়ে বিভিন্ন অধিবেশনে পঠিত প্রায় শতাধিক প্রবন্ধের খবর লেখক দিয়েছেন ও উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনাও করেছেন। এই শতকের গোড়ার দিকে মুসলমান সমাজে আধুনিকতাকে প্রবহমান করার কাজে যাঁরা অংশ নিয়ে-ছিলেন, অথচ বর্তমানে যাঁরা বিস্মৃত-প্রায়, তাঁদের নাম ভেসে ওঠে এই প্রবন্ধ পাঠে। এককথায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সামগ্রিক তথ্যনিষ্ঠ পরিচয় পাওয়া যাবে, এই লেখায়। এজন্যে এটিকে সংকলনের প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে এবং প্রকাশিত হয়েছিল বিভাগ থেকে প্রকাশিত 'ভাষা ও সাহিত্যপত্র'-এর ১৩৮৮ সালের সংখ্যায়।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি 'ঢাকার মুসলিম সাহিত্য-সমাজ'; রচয়িতা আবদুল হক। এটিকে প্রথম প্রবন্ধের পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। ওয়াকিল আহমদের যেখানে লক্ষ্য ছিল মুসলিম সাহিত্য-সমাজের
(পৃষ্ঠা-৮)
সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা, সেখানে আবদুল হকের চেষ্টা ছিল এর আন্তর পরিচয়কে উদঘাটিত করা। এর জন্য তিনি নির্ভর করেছেন -, 'শিখা'য় প্রকাশিত প্রবন্ধাবলীর ওপর। অবরোধপ্রথা, সুদগ্রহণ, ললিত-কলার চর্চা, সাম্প্রদায়িকতা, সাহিত্যের ভাষাকে আরবী-ফারসী-বহুল করার উদ্যোগ, সর্বোপরি ইসলাম ধর্মের বিধিবিধানকে খোলা মনে মূল্যায়ন করা প্রভৃতি সমস্যাকে সাহিত্যসমাজীরা কিভাবে চিহ্নিত করেছেন ও সমাধান নির্দেশ করেছেন, সে-সব তিনি প্রয়োজনীয় মন্তব্য ও উদ্ধৃতিসহযোগে আলোচনা করেছেন। এই প্রবন্ধগুলির বক্তব্যই সেকালের মুসলিম সমাজে শিখাপন্থীদের নন্দিত ও নিন্দিত করেছিল।
সাহিত্যসমাজের মর্মপরিচয় বহনকারী এই প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে তাঁর 'সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ' (ঢাকা: ১৯৬৮) নামক গ্রন্থ থেকে।
কাজী আবদুল ওদুদের রাজনৈতিক চিন্তা বিষয়ক তাঁর আরো একটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এই বইয়ে। এটি একটি ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ, কেননা ওদুদ-চিন্তার এ-দিকটি আমাদের আলোচকদের দৃষ্টি কম আকর্ষণ করেছে, যদিও প্রচলিত ধারণা যে, রাজনৈতিক মত-পার্থক্যের দরুণ, ফরিদপুরের সন্তান হওয়া-সত্ত্বেও দেশবিভাগের পর তিনি পাকিস্তানে হিজরত করেননি। তিনি নীতিগতভাবে ভারতবিভাগে বিশ্বাসী না-হলেও, "ভারত ও পাকিস্তানের বহু দায়িত্বসম্পন্ন নেতার সম্মতিক্রমে যখন দেশবিভক্ত হলো ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো" তখন তা পুরোপুরি মেনে নিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের তিনি তা যে-কোনো উন্নতিতে আনন্দবোধ করেছেন। তবে তিনি আজীবন ছিলেন গান্ধীবাদের তিন নীতির সমর্থক সত্যাগ্রহ, অহিংসা ও চরকা। আধুনিক সমাজে এগুলোর উপযোগিতা সম্পর্কে তার মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি।
আবদুল হক কাজী সাহেবের রাষ্ট্রচিন্তার পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু মূল্যায়ন করেননি। করলে ভাল হত, কারণ আধুনিক কালে ওদুদ-চিন্তার অপ্রাসঙ্গিকতার প্রসঙ্গ উঠলে এদিকটি প্রধান বিবেচ্য হবে। তাঁর বিপ্লববিরোধিতা, সংঘশক্তির প্রতি অবিশ্বাস, গান্ধীবাদের প্রতি অচলা ভক্তি তাঁকে একালের মনের কাছে অপাংক্তেয় করে তুলেছে। তাঁর চিন্তার এদিকটি নির্মোহ আলোচনার দাবি রাখে। সীমাবদ্ধতা সত্বেও, আবদুল হক যে আলোচনার সূত্রপাত করেছেন, সে-কারণে এটি ব্যতিক্রমধর্মী। এটি সংকলিত হয়েছে তাঁর 'সাহিত্য ও স্বাধীনতা'
(পৃষ্ঠা-৯)
ঢাকা: ১৯৭৪) নামক প্রবন্ধ পুস্তক থেকে।
এই সংকলনের তৃতীয় প্রবন্ধ ড. কাজী মোতাহার হোসেনের 'কাজী আবদুল ওদুদ ও তার অবদান'। কাজী মোতাহার হোসেন কাজী আবদুল ওদুদের আবাল্য সুহাদ ছিলেন, তাঁর পিতার জন্মস্থানও বাগমারা গ্রামে। সাহিত্যসমাজের আন্দোলনেও তিনি একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন; 'শিখা' পত্রিকা দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি প্রধানত ওদুদ সাহেবের পারিবারিক ও বাল্যজীবনকথা বেশি আলোচনা করেছেন এবং তার ফাঁকে ফাঁকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কিছু চমকপ্রদ তথ্য হাজির করেছেন। তথসমৃদ্ধি ও অন্তরঙ্গ সুরের সমবায়ে প্রবন্ধটি হয়েছে বিচিত্র ও মূল্যবান। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত 'মাসিক উত্তরাধিকার' পত্রিকার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
এস, এন, কিউ জুলফিকার আলী 'কাজী আবদুল ওদুদ' একই পর্যায়ের স্মৃতিচিত্র। এখানে প্রধানত পাওয়া যাবে কাজী সাহেবের মধ্যজীবনের কাহিনী। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এই বিশ বছর প্রবন্ধকার নানাভাবে তাঁর সাহচর্যে এসেছিলেন। ঐ সময়টা ওদুদ সাহেবের জীবনের মধ্যাহ্নকাল সবদিক দিয়ে। ফলে পেশাগত ও সাহিত্যজীবনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের সমাহারে প্রবন্ধটি মূল্যবান হয়েছে ও তাঁকে জানার সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষতা গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখান, পেশাগত জীবনে উন্নতির ধান্ধায় না-ঘোরা, শিক্ষক হিসাবে খ্যাতি ও চারিত্রিক ঋজুতার কথা এই প্রবন্ধপাঠে জানা যায়। এই প্রত্যক্ষতা লেখাটির প্রধান গুণ। এটি প্রকাশিত হয়েছিল পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখার মুখপত্র 'পরিক্রম'-এর জুন-ডিসেম্বর ১৯৭০ সংখ্যায়।
অন্নদাশংকর রায়ের 'জীবনদার্শনিক ওদুদ' মোটামুটি একই ধরনের রচনা হলেও ভিন্নস্বাদের ও ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতের। লেখক জীবনে দুজনে সমগোত্রীয় ছিলেন; তাঁদের বন্ধুত্বের সুরও ছিল সাহিত্য ও জীবন-জিজ্ঞাসা। কাজী সাহেবের পরলোকগমনের পর স্মৃতিচিত্রমূলক এই প্রবন্ধটি তিনি রচনা করেছিলেন। এটি প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তা-হিক 'দেশ' পত্রিকায় ও পরবর্তীকালে ১৩৭৮ সালের 'সাহিত্যিক বর্ষ-পঞ্জী'তে। আমরা শেষোক্ত সংকলন থেকে এটি সংগ্রহ করেছি।
(পৃষ্ঠা-১০)
প্রবন্ধকার তাঁকে বেশী করে জেনেছেন শেষ দিকে, কলকাতা জীবনে। ওদুদ সাহেবের শেষ জীবনে আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতিতে উদ্বেগ ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া, সাহিত্যসাধনার প্রাতি-ষ্ঠানিক স্বীকৃতি, দিনানুদৈনিকের উর্ধ্বে অবস্থিত মহৎ জীবনের স্বরূপ। অনুেষার কথা এখানে আভাষে-ইঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। বাইরের ঘটনার বিবরণপ্রদান এখানে মুখ্য নয়, বাঙালীত্ব, ইসলাম ও মানবিকতা-বাদের মৌল ধারণায় প্রতিষ্ঠিত থেকে গান্ধী-রবীন্দ্রনাথ-গোটে ও রাস মোহনের সাধনাকে আত্মস্থ করতে তিনি-যে প্রয়াসী হয়েছিলেন, সেই অশান্ত জীবনতৃষ্ণার পরিচয় এখানে অনাবৃত হয়েছে।
আবুল ফজলও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি 'শিখা'র পঞ্চম বর্ষে এর সম্পাদক ছিলেন এবং সাহিত্যসমাজের অধিবেশনে দুটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন: 'পর্দাপ্রথার সাহিত্যিক অসুবিধা' (১৯২৭) ও 'তরুণ আন্দোলনের গতি' (১৯২৯)। পরবর্তী-জীবনেও সাহিত্যসমাজের প্রেরণা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি।। বর্তমান সংকলনের 'কাজী আবদুল ওদুদঃ সাহিত্য ও মতাদর্শ' নামক সঙ্কলিত প্রবন্ধটি তাঁর রচনা। ওদুদ-এর প্রবন্ধ চিন্তার পরিচয় প্রদান তাঁর প্রধান চেষ্টা ছিল-সঙ্গে-সঙ্গে লেখক তাঁর পরিশ্রম, আদর্শানুরক্তি, জীবন-অনুসন্ধিৎসা ও সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য উৎকণ্ঠার কথা তিনি বিস্তারিত-ভাবে আলোচনায় এনেছেন। ওদুদ সাহেবের পরিশ্রম শুধু মননশীলতা অর্জনে সীমাবদ্ধ ছিলনা, এটা প্রসারিত হয়েছিল গদ্যশৈলী নির্মাণেও। এই ব্যাপক প্রস্তুতির ফলেই তিনি লাভ করেছিলেন চিন্তায় ও শৈলীতে বিশিষ্টতা। আবুল ফজল প্রবন্ধটি লিখেছেন সানুরাগে। এটা প্রাক্-স্বাধীনতার কালে তথা পাকিস্তান আমলে প্রকাশিত হয়েছিল। ফলে তাঁর রচনায় 'স্বাধীনতা' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ১৯৪৭-এর দেশবিভাগ বোঝাতে। প্রবন্ধটি নেওয়া হয়েছে তার 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা' নামক গ্রন্থ থেকে। ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত 'নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন'-এ এটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে 'কাজী আবদুল ওদুদঃসাহিত্য ও জীবনদর্শন' শিরোনামে।
আহমদ শরীফ-এর 'কাজী আবদুল ওদুদ' প্রবন্ধটি তাঁর 'যুগযন্ত্রণা' (ঢাকা: ১৯৭৪) নামক পুস্তক থেকে নেওয়া। কাজী সাহেবের ভাবাদর্শের মূল্যায়ন রয়েছে এতে। সাহিত্যবিচারের চেয়ে
(পৃষ্ঠা-১১)
চিন্তার সীমা ও সম্ভাবনা নির্দেশের দিকে তিনি প্রধানত নজর দিয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন ঘে, কাজী সাহেব চিন্তার ক্ষেত্রে "ভাববিপ্লবী নন,
এমনকি সাধারণ অর্থে দ্রোহীও নন। দুই কূল রক্ষা করে জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রতীচ্য-প্রভাবজাত সমস্যা-সমাধানে ছিলেন প্রয়াসী। 1 তাই তিনি স্থিতধী সংস্কারক, সহিষ্ণু সনাতনী ও উদার হিতবাদী।'
কাজী আবদুল ওদুদ-এর মৃত্যুর পর পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চল শাখা কর্তৃক আয়োজিত শোকসভায় ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ডঃ আনিসুজ্জামান ও জনাব বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। প্রবন্ধত্রয় প্রকাশিত হয়েছিল সংঘের মুখপত্র 'পরিক্রম-' এর জুন-ডিসেম্বর ১৯৭০ সংখ্যায়। 'কাজী আবদুল ওদুদ' নামক ডঃ চৌধুরীর প্রবন্ধটি 'আগুন নয়, আলো' শিরোনামে বর্তমান সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাজী ওদুদকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনিও আহমদ শরীফের পথ অবলম্বন করেছেন, তবে কোনো-কোনো ক্ষেত্রে তাঁর আলোচনা গভীরতর। প্রবন্ধের নামকরণের মধ্যেই তিনি ওদুদের সাধনাকে প্রকাশ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, জ্ঞান ও প্রেম এই দুইকে মিলিয়ে ওদুদ-মানসকে বোঝা সম্ভব এবং সেকালের অধিকাংশ মুসল-মান বুদ্ধিজীবীর প্রধান মানসতা, হীনমন্যতাকে তিনি সবলে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে সেজন্য তিনি মিশতে পেরেছিলেন অমন স্বাভাবিকতায়। সেসূত্রে বোঝা যায় যে, 'শাশ্বত বঙ্গ' লেখার প্রেরণা তাঁর সহজাত এবং তাঁর চিন্তার মূল লক্ষণ ইতিবাচক। চিন্তাবিদ কাজী ওদুদের চিন্তার প্রধান দুর্বলতাসমূহও প্রবন্ধকার নির্দেশ করেছেন-মুক্তির সঙ্গে ভক্তির, এবং বুদ্ধির মুক্তির সঙ্গে মোহগাশ কিভাবে আলো-ছায়ার মত পাশাপাশি জড়িয়ে আছে, তা-ও তিনি লক্ষ্য করেছেন।
অপরদিকে ডঃ অনিসুজ্জামান 'কাজী আবদুল ওদুদ' প্রবন্ধে তাঁর মানবিকতাবাদের সাধনাকে কেন্দ্রীয় মূল্য দিয়ে আলোচনা করেছেন। যানববাদ বাঙালী মুসলমান সমাজে এসেছিল খণ্ডিত আকারে, সেটা নির্দিষ্ট ভূগোল, ইতিহাস ও শাস্ত্রের সীমা মান্য করত। কাজী আবদুল ওদুদ মানবিকতাকে তার যথার্থ' ভিত্তিতে হাদয়ঙ্গম করেছিলেন। সেজন্য তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ভারতবর্ষের ইতিহাসকে মিলাতে চেয়েছিলেন; মোতাজিলাদের চিন্তা, সাদীর কবিতা, আতাতুর্কের বিপ্লব, দাদু-কবীরের
(পৃষ্ঠা-১২)
ভক্তিসাধনা, রামমোহনের সংস্কার প্রচেষ্টা ও রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনকে একইসূত্রে গ্রথিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল। "আমাদের সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সমৃদ্ধিতে, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে, জীবনকে নতুন করে দেখবার প্রয়াসের মধ্যে" কাজী ওদুদের সাধনা চরিতার্থতা লাভ ফরেছে বলে তিনি লক্ষ্য করেছেন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর 'একজন সৎব্যক্তির হহৃদয়' নামের প্রবন্ধে কাজী আবদুল ওদুদকে মূল্যায়ন করেছেন 'সত্যের নিঃসঙ্গ যাত্রী' একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে। একবিচারে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, মুসলমান সমাজে বিরাট স্থায়ী আলোড়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে-সাময়িক তরঙ্গ তুলে আন্দোলন হারিয়ে গেছে বৃহৎ সমাজের অন্ধকার গর্ভে। আন্দোলনের প্রেরণা শুধু টিকে আছে এক-একজনের নিঃসঙ্গ সাধনায়। এই ব্যর্থতার কারণ লেখক অনুসন্ধান করেছেন ওদুদের ভাববাদ নির্ভরতায়, যুক্তি ও ধর্মকে মেলাবার প্রয়াসে, সর্বোপরি জনসাধারণের সঙ্গে সহমর্মিতার অভাবে-লেখকের ভাষায় "বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন যুক্তিচর্চার এলিট ভূমিকায়" পর্যবসিত হাওয়ায়। এভাবে এগিয়ে গিয়ে - কাজী সাহেব জনবিচ্ছিন্নতার পথে উঠেছেন ও তাঁর সাধনা ট্র্যাজিক গুরুত্ব লাভ করেছে।
'কাজী আবদুল ওদুদের মর্ম-পরিচয়' প্রবন্ধে বশীর আলহেলাল কাজী সাহেবের মানস গঠনের সাংস্কৃতিক পরিবেশ বর্ণনা করে কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছেন। আবদুল ওদুদের বস্তুবাদ-ও সমাজতন্ত্রবিরোধিতা তাঁর দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে। সমাজ-পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে সীমাবদ্ধ বা ভাববাদী ধারণা থেকে যে তিনি অতিমাত্রায় অহিংসা পদ্ধতির সমর্থক হয়েছেন এমন ইঙ্গিতও প্রবন্ধকার করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী হলেও, রবীন্দ্রনাথের নব নব গ্রহণক্ষমতা যে ওদুদের ছিলনা, তা-ও লেখক উল্লেখ করেছেন। তবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ওদুদের চিন্তার দূরদর্শিতাকে প্রমাণ করেছে, এটা তিনি মনে করেন। বশীর আল হেলালের প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল 'বাংলা একাডেমী গবেষণা পত্রিকা'র সপ্তদশ বর্ষ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংখ্যায়।
এই সংকলনের জন্য বিশেষভাবে অনুরুদ্ধ হয়ে ডঃ নাজমা জেসমিন চৌধুরী ওদুদ প্রতিভার একটি অনালোচিত কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়
(পৃষ্ঠা - ১৩)
দিক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন সেটি তাঁর কথাসাহিত্য সাধনা। কাজী সাহেব সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন ছোটগল্প ও উপন্যাস সা রচনার দ্বারা এবং এর ফলে তাঁর জীবনের ধারাও বদলে গিয়েছিল। ক পরবর্তীকালে প্রবন্ধরচনায় মনোনিবেশ করলেও, তরুন ওদুদের মানস- জ প্রবণতার সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে ঐ স্বভালোচিত সাত আটটি গল্প ও ত দুটি ক্ষুদ্রাকায় উপন্যাসের মধ্যে। বলতে কি, এগুলোর মধ্যে বীজাকারে ওদুদ-মানসের যে-পরিচয় রয়েছে, তা-ই কালে-কালে পুষ্পষ্ট হয়ে চিন্তাবিদ ওদুদকে নির্মাণ করেছে। তাঁর রোমান্টিক প্রবণতা, সরল সমাজচেতনা, মহৎ ব্যক্তিত্বের প্রতি পক্ষপাত, দ্বন্দ্বহীন জীবনের প্রতি আসক্তি, পরি- অ বেশের সঙ্গে প্রেমের যোগ আমরা কথাসাহিত্যেই প্রথম লক্ষ্য করি। (জ সমালোচক এই দিকগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছেন এবং নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক-ভাষ্য রূপ ঐগুলিকে ব্যাখ্যা করেছেন। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে সাহিত্যিক ওদুদের পরিচয় পূর্ণ হয়েছে।
8
এই সংকলনের লেখকদের মধ্যে একমাত্র অন্নদাশংকর রায়ই (জন্ম ১৯০৪, উড়িষ্যা) বাংলাদেশের বাইরের। উচ্চ রাজকার্যে নিয়োজিত থেকেও (আই.সি.এস) তিনি নিবিষ্টচিত্তে সাহিত্যসাধনা করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য কথাসাহিত্যিক ও মননশীল প্রাবন্ধিক। প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন "পথে-প্রবাসে" রচনা করে; পরে উপন্যাস লিখেছেন আরো কয়টি; প্রবন্ধ লিখেছেন অজস্র। ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন ফরিদপুর জেলার বাগমারা গ্রামে ১৮৯৭সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক পরিচয় মুখ্য হলেও চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। প্রবন্ধ সংকলন 'সঞ্চয়ন' তাঁকে খ্যাতিমান করেছে। ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এস. এন. কিউ. জুলফিকার আলীও, (জ, ১৯০১)। শিক্ষক ও প্রশাসক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে অবসর জীবন যাগন করছেন। রম্যরচনার লেখক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবে তিনি পরিচিত। আবুল ফজল জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামে, ১৯০৫ সালে। শিক্ষাবিদ ও চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর প্রধান পরিচয়। তবে
(পৃষ্ঠা-১৪)
সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় সঞ্চরণ অবাধ। বহু দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করে বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন। 'সাহিত্য-সংস্কৃতি জীবন', 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা', 'সমাজ সাহিত্য রাষ্ট্র', 'শুভবুদ্ধি' তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধপুস্তক। আবদুল হকের জন্ম রাজশা-হীতে, ১৯২০ সালে। বাংলা একাডেমীর পাঠ্যপুস্তক ডিভিশনের পরি-চালক হিসেবে তিনি অবসর নিয়েছেন। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে। 'সাহিত্য ঐতিহ্য মূল্যবোধ', 'সাহিত্য ও স্বাধীনতা',তে তাঁর প্রধান-প্রধান প্রবন্ধসমূহ সংকলিত হয়েছে। ডঃ আহমদ শরীফ (জ. ১৯২১) বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন। তিনি বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত, গবেষক ও প্রবন্ধকার হিসেবে স্বীকৃত। 'বিচিত চিন্তা', 'স্বদেশ অন্বেষা' 'যুগযন্ত্রণা', 'কালিক ভাবনা', 'বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য' তাঁর উল্লেখ যোগ্য কীতি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজী সাহিত্যের অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জ. ১৯৩৬, বিক্রমপুর, ঢাকা), বাংলা-দেশের খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক হিসেবে সুপরিচিত। 'দ্বিতীয় ভুবন', 'আরণ্যক দৃশ্যাবলী', 'নিরাশ্রয় গৃহী ও অন্যান্য প্রবন্ধ', 'শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ', 'স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি' তাঁর প্রধান-প্রধান প্রবন্ধ-সংকলন। বশীর আলহেলাল (জ ১৯৩৬, মুর্শিদাবাদ) গাল্পিক ও প্রবন্ধকার হিসেবে পরিচিত এবং বাংলা একাডেমীর অনুবাদ ডিভিশনে উপপরিচালক পদে অধিষ্ঠিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধপুস্তক 'সাম্প্রতিক কবি সাম্প্রতিক কবিতা'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ১৯৩৬ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রধানতঃ প্রবন্ধ লেখেন ও গবেষণা করেন। 'কণ্ঠস্বর' 'স্বদেশ ও সাহিত্য', 'চিত্রশিল্পঃ বাংলাদেশের' তাঁর প্রধান-প্রধান প্রবন্ধপুস্তক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালে চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট গবেষক হিসাবে তিনি সুপরিচিত। 'মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য', 'মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র', 'স্বরাপের সন্ধানে' তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গবে-ষণাগ্রন্থ। ডঃ ওয়াকিল আহমদের জন্মও পশ্চিম বাংলায়, ১৯৪১ সালে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণা প্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে 'বাংলার লোক-
(পৃষ্ঠা-১৫)
সংস্কৃতি', 'বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান' ও 'মুসলিম বাংলায় বিদেশী পর্যটক'। ডঃ নাজমা জেসমিন চৌধুরীর জন্ম ফরিদপুরে, ১৯৪১ সালে। নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও মূখ্যত তিনি গবেষক। তাঁর প্রধান গবেষণা গ্রন্থ, 'বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি'।
৫ বর্তমান সংকলনের একটি ত্রুটির কথা এখানে স্বীকার করে নেওয়া ভাল। বালাদেশে ওদুদ-চর্চার স্বরূপ মোটামুটি এতে পাওয়া গেলেও ওদুদকে সর্বত্র বস্তুনিষ্টভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে এমন বলা যাবেনা। কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল ফজল বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কর্মী ছিলেন, ওদুদের সঙ্গে তাদের সখ্যতাও ছিল নিবিড়। এস.এন. কিউ জুলফিকার আলী কর্মজীবনে তাঁর সহচর্য লাভ করেছিলেন, আর আবদুল হক ও বশীর আলহেলাল জীবনের এক-এক পর্যায়ে পেয়েছিলেন তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্য। আহমদ শরীফ, অন্নদাশংকর রায়, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান ও বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর-এর প্রবন্ধ রচিত হয়েছে শোক-বিধুর পরিবেশে। ওয়াকিল আহমদ মূলতঃ পটভূমিকাকে আলোকিত করেছেন এবং নাজমা জেসমিন চৌধুরীর আলোচ্য বিষয় ছিল ওদুদ-প্রতিভার অপ্রধান দিকটি। একমাত্র বর্তমান প্রবন্ধকারেরই সুযোগ ছিল তাঁকে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের, তবে বলাই বাহুল্য যে, এক্ষেত্রে বাধা হয়েছে তাঁর অক্ষমতা। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আমার প্রবন্ধ- 'মুক্তি সাধক কাজী আবদুল ওদুদ' প্রথম প্রকাশিত হয় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা'য় (পঞ্চদশ সংখ্যা, জুন, ১৯৮২)। যাই হোক, বাংলাসাহিত্যের একজন সৎ ও বরেণ্য চিন্তা-বিদকে নিয়ে রচিত এদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের প্রবন্ধের এই সংগ্রহ ওদুদ ও ওদুদ-চর্চা সম্পর্কে পাঠকদের মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পারবে।
সাঈদ-উর রহমান
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৮.৮.৮২
(পৃষ্ঠা - ১৬)
The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়
comment url