OrdinaryITPostAd

উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস

 বাংলা নাটক বাংলা সাহিত্যের একটি নব্য শাখা এবং এই উনিশ শতকের দিকেই বাংলা নাটকের পথচলা শুরু হয়েছে।আমাদের আর্টিকেলের এই অংশে উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর আলোচনা থাকবে। আশা করছি এই আর্টিকেল অর্থাৎ উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস নিয়ে লেখা আর্টিকেলটি পড়লে আপনি সন্তুষ্ট হবেন। উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস নিয়ে বিস্তর জানতে চাইলে আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। 

ভূমিকা অংশ | উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস 

  উনবিংশ শতকে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে বাংলা সাহিত্যের যে সব শাখা নব জীবন লাভ করে নাটক তাদের মধ্যে অন্যতম।নাটক হলো আধুনিক ও গতিশীল শিল্প প্রকরণ।     নাটক একটি মিশ্র শিল্প। নাটক অভিনীত না হলে নাটকের কোন মূল্য থাকে না। প্রায় দুই হাজার বছর পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে নাটকের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যে উৎকৃষ্ট নাটক রচিত ও অভিনীত হয়েছিল, ছিল সুপরিকল্পিত নাট্যমঞ্চ। কিন্তু প্রাচীনকালে আমাদের এ অংশে অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলে যাত্রার মত অভিনীত হতো এবং এগুলোই দর্শক উপভোগ করত। 


থিয়েটার বা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস | উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস 

       সংস্কৃত অলংকারিকগণ নাট্যসাহিত্যকে কাব্যসাহিত্যের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। তাঁদের মতে কাব্য দু'প্রকার - দৃশ্যমান ককব্য ও শ্রব্য কাব্য।  নাটক দৃশ্য কান্য ও শ্রব্য কাব্যের সমন্বয়ে রঙ্গমঞ্চের সাহায্যে গতিমান মানব জীবনের প্রতিচ্ছবি  আমাদের সামনে তুলে ধরে। রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস বাংলা নাটকের ইতিহাসের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত। বাংলা নাটকের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে থিয়েটার বা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা নাট্যশালার দ্বার উন্মোচিত করেন রুশ দেশীয় হেরাসিম লেবেডেফ কলকাতার ডোমতলায় 'Bengally Theatre' নামে ১৭৯৫ সালে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে। এই সালেই তিনি ইংরেজি 'Disguise' (১৭৯৫) ও 'Love is the Best Doctor' (১৭৯৬)  নামে দুটি নাটক অভিনয় করিয়েছেন।

         অর্থাৎ থিয়েটার স্থাপনের জন্য কী কী প্রয়োজন সেসবের ধারণা আমরা লেবেডেফের কাছে পাই। ইতিমধ্যেই ইংরেজদের দ্বারা কয়েকটি রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে 'সাঁসুনি রঙ্গালয়' সর্বাপেক্ষা খ্যাতি অর্জন করেছিল। অবশ্য তার পূর্বেও ক্যালকাটা থিয়েটার ও 'চৌরঙ্গী থিয়েটার' স্থাপিত হয়েছিল। এইসব থিয়েটারে সাধারণ বাঙ্গালিদের যাতায়াত ছিল না। 

নাট্যশালা স্থাপনের চেষ্টা শুধু ইংরেজদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না, এরপর কলকাতায় আস্তে আস্তে নাটক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। এরপর ১৮৫৮-১৮৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে 'শখের থিয়েটার' নির্মিত হয়। শখের থিয়েটার  এই অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে জমিদার বাড়িতে কলকাতার উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণি তারা বাড়িতে বাড়িতে বা তাদের নিজস্ব অর্থায়নে এরকম থিয়েটার স্থাপন করেছে। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উৎসাহ লেবেদেভের কাছ থেকেই নেওয়া এবং জমিদার শ্রেণিরাই এর পৃষ্ঠপোষক। 

 নাট্যপ্রিয় ধনশালী বাঙালিও এ বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের 'হিন্দু থিয়েটার'ই বাঙালি প্রতিষ্ঠিত প্রথম নাট্যশালা। এখানে 'জুলিয়াস সিজর' ও উইলসন অনূদিত 'উত্তররামচরিত' এর অভিনয় হয়। প্রথম বাংলা নাটক 'বিদ্যাসুন্দর' এর ও অভিনয় হয়। এভাবে অল্পকিছুদিনের মধ্যেই কয়েকটি নাট্যশালা প্রতিষ্টিত হল। তাদের মধ্যে হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১),  অরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যুৎ সাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭),বেলগাছিয়া থিয়েটার (১৮৫৮), স্টার থিয়েটার (১৮৮৩), পাথুরিয়াঘাটা রঙ্গনাট্যালয়(১৮৬৫) প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। 

গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটারের মধ্যে অন্যতম হল 'পাবলিক থিয়েটার' যাকে 'ন্যাশনাল থিয়েটার'ও বলা হয়। পাবলিক থিয়েটার বা ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭২ সালে। কলকাতার বাংলা বাজারে অ্যামেচার থিয়েটারের যারা সদস্য ছিলেন তারাই এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করলেন।এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলা নাট্য সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হল। নাট্যমঞ্চের প্রতিষ্টার মধ্যদিয়ে মঞ্চ নাটকের প্রয়োজনে বাংলা নাট্যকারেরা নাটক নির্মান শুরু করে

         বিনোদনের উদ্দেশ্যে থিয়েটার বা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৭৯৫ সালে বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্টা করেছিল লেবেদেভ। তারপর এই থিয়েটার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নাটকের ইতিহাসকে ০৩ ভাগে(সময়সীমার দিক থেকে) ভাগ করা হয়েছে।  যথা ১. ১৮৫২-৭২   ২. ১৮৭২-৪২   ৩.১৯৪২-বর্তমান

প্রথমার্ধের অর্থাৎ ১৮৫২-১৮৭২ সালের মধ্যে লিখিত উল্লেখযোগ্য কিছু নাটক হলো - তারাচরণ শিকদারের 'ভদ্রার্জন'(১৮৫২), কালি প্রসন্ন সিংহের 'বাবুনাদ'(১৮৫৩), উমেশচন্দ্র মিত্রের 'বিধবা বিবাহ'(১৮৫৬), হরচন্দ্র ঘোষের 'বানুমতির চিত্রবিলাস',  

এই রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনেই উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাঙ্গালা নাটকের উদ্ভব  শিল্পসম্মত নাট্যকারদের ইতিহাস পড়ার পূর্বে যারা বাংলা নাটকের উদ্ভব।শিল্পসম্মত নাট্যকার হিসেবে উনিশ শতকের চারজন নাট্যকারকে গুরুত্ব দেওয়া যায় তারা হলেন মধুসূদন দত্ত, গিরিশচন্দ্র ঘোষ,  দীনবন্ধু মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।  কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন মনোমোহন বসু, উমেশ চন্দ্র গুপ্ত,  প্রমোদনাথ মিত্র, সুকুমার দত্ত, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, গোপালচন্দ্র মুখপাধ্যায়সহ আরো অনেকে।শিল্পসম্মত নাট্যকারদের ইতিহাস পড়ার পূর্বে যারা বাংলা নাটকের উপক্রম ছিলেন তাদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল-

     রামনারায়ণ তর্করত্ন(১৮২২-১৮৮৬) বাংলা মৌলিক নাটক রচয়িতা হিসেবে পরিচিত । বাংলা ভাষায় প্রথম বিধিবদ্ধ নাটক রচনার জন্য তিনি ‘নাটুকে রামনারায়ণ’ নামে পরিচিত ছিলেন। কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪) তাঁর প্রথম ও শ্রেষ্ঠ নাটক। এতে হিন্দুসমাজে বহুবিবাহ প্রথার কুফল সম্পর্কে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়। তাঁর অন্যান্য রচনা: রত্নাবলী (১৮৫৮), নব-নাটক (১৮৬৬), বেণীসংহার (১৮৫৬), মালতীমাধব (১৮৬৭), রুক্মিণীহরণ (১৮৭১), কংসবধ (১৮৭৫) ইত্যাদি। পতিব্রতোপাখ্যান (১৮৫৩) তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ। এছাড়া তিনি যেমন কর্ম তেমনি ফল (১৮৬৩), উভয় সঙ্কট (১৮৬৯), চক্ষুদান প্রভৃতি প্রহসনও রচনা করেন। তাঁর অধিকাংশ নাটক ও প্রহসন বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চ, কলকাতার অভিজাত ধনিকশ্রেণীর নিজস্ব মঞ্চ এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালায় বহুবার অভিনীত হয়।

  বাংলা নাটকের ইতিহাসের সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে কিভাবে নাটকগুলো জীবনের কথকথা হয়ে উঠছে? বিশেষ করে উনিশ শতকের সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থার(ব্রিটিশ) পরিস্থিতিগুলো ব্যঙ্গভাবে তুলে ধরেছেন এবং করুন রস ও বিদ্যমান তাদের নাটকগুলোতে।

মধুসূদন দত্ত ১৮৫৯-৬১ সাল পর্যন্ত নাটক রচনা করেছেন। রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী (১৮৫৮) নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি বাংলা নাট্যসাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন এবং তাঁর মধ্যে তখন বাংলায় নাটক রচনার সংকল্প জাগে। এই সূত্রে তিনি কলকাতার পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এমন একটি পরিস্থিতিতে নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদনের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ ঘটে। তিনি মহাভারতের দেবযানী-যযাতি কাহিনী অবলম্বনে ১৮৫৮ সালে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন শর্মিষ্ঠা নাটক। এটিই প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক নাটক এবং একই অর্থে মধুসূদনও বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার।

পরের বছর মধুসূদন রচনা করেন দুটি প্রহসন: একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রথমটিতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলদের মাদকাসক্তি, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচারসর্বস্ব ও নীতিভ্রষ্ট সমাজপতিদের গোপন লাম্পট্য তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রেও মধুসূদন পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর প্রহসন দুটি কাহিনী, সংলাপ ও চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকে আজও অতুলনীয়। তার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হল শার্মিষ্ঠা (১৮৫১), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী, মায়াকানন ইত্যাদি।

 দীনবন্ধু মিত্র (১৮৩০-৭৩) বাংলা নাটকের দুই-একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের অন্যতম। দীনবন্ধুমিত্রকে বলা হয় জীবনশিল্পী।  তাঁর মত নাটকে সাধারণ জীবন চিত্রণ এর পূর্বে  আর কেউ করে নি। দীনবন্ধু ডাকবিভাগে কাজ করার সুবাদে নানা ধরনের মানুষের সাথে মেশার সুযোগ পেয়েছিলেন সেই সামাজিক অভিজ্ঞতাকে শিল্পরসে মিলিয়ে দিলেন এটি তাঁর  একটি শিল্প সাফল্য।

        বিশেষ করে  'নীলদর্পণ'(১৮৬০) তার একটি শিল্প সফল নাটক।  সমকালের নীলচাষ ও  নীলকর সাহেবদের প্রজাপীড়ন এবং শাসকশ্রেণীর পক্ষপাতমূলক আচরণ নাটকটির বিষয়বস্ত্ত। নাটকটি তৎকালীন সমাজে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং কৃষকদের নীলবিদ্রোহে ইন্ধন জোগায়। নীলদর্পণ নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীলবিদ্রোহের কাহিনি বর্ণনার দ্বারা সমকালীন সমাজকে তুলে ধরেছেন । তিনি এই নাটকটিতে সমাজের অসহায় ও অত্যাচারিত নীলচাষীদের দুঃখ-দুর্দশার বর্ণনার মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের অসহায় প্রজাদের দুঃসহ লাঞ্ছনা তুলে ধরেছেন । এই নাটকের গোলক বসু, নবীন মাধব, বিন্দু মাধব, সৈরিন্ধ্রী, সাবিত্রী, সরলতা প্রভৃতি চরিত্র বর্ণনার মধ্য দিয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতা ধরা পড়ে । গোলক বসুর সহজ-সরল বিশ্বাস, নবীন মাধবের কর্তব্যবোধ ও পিতৃভক্তি, সৈরিন্ধ্রীর পতিব্রতা, সাবিত্রীর অপত্য স্নেহ বাঙালি সমাজজীবনের প্রতিচ্ছবি মেলে ধরে । দীনবন্ধু মিত্র তার এই নাটকে বাস্তব সমাজ-সমস্যা, সমাজের পরিচিত প্রতিদিনের ঘটনা, চেনামুখ ও তাদের চোখের জল ও মুখের হাসি তুলে ধরেছেন । নীলকরদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সমাজের রায়ত, সম্পন্ন কৃষক ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সকলে একজোট হয়েছিল । তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ভাষা এই নাটকে ধরা পড়ে ।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং পাদ্রি জেমস লং তা প্রকাশ করে আদালত কর্তৃক অর্থদন্ডে দন্ডিত হন।  বঙ্কিমচন্দ্র নীলদর্পণকে আঙ্কল টমস কেবিন-এর সঙ্গে তুলনা করেন। নাটকটি রচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় চেতনার পথিকৃৎ হয়ে আছে। এটিই বিদেশী ভাষায় অনূদিত প্রথম বাংলা নাটক। ১৮৬০ সালে ‘কস্যচিৎ পথিকস্য’ ছদ্মনামে নাটকটি প্রথম  ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় এবং ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর এটি দিয়েই শুরু হয় সাধারণ রঙ্গালয়ের অভিনয়। দীনবন্ধু মিত্র তার 'নীলদর্পণ' নাটকের মাঝে চরিত্র চিত্রায়ণ কৌশল ও জীবন প্রনালী উপন্যাসের মতোই গ্রাম বাংলার সাংস্কৃতিক জনজীবনকে তুলে ধরেছেন। দীনবন্ধু মিত্রের নাটক,  জীবনাভিজ্ঞতা,  মানবিক আবেদন সম্পর্কে  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যেটাকে জীবন ভিত্তিক প্রবন্ধ বলা যেতে পারে। তিঁনি প্রবন্ধটি লিখেছিলেন 'রায় দীনবন্ধু মিত্রের জীবনী' এমন একটি শিরোনামে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন দীনবন্ধু মিত্র 'নীলদর্পণ', 'সধবার একাদশী', 'নবীন তপস্বীনী' এসব নাটকে সংলাপ ও চরিত্র চিত্রায়ণে তাঁর মানবিক আবেদন ও জীবনাভিজ্ঞতাকে কিভাবে কাজে লাগিয়েছেন।  

দীনবন্ধু মিত্রের যে প্রহসন ছিল তার মধ্যে আমরা সমাজ ও বাস্তবতা দেখতে পাই। ব্যঙ্গার্থক ভঙ্গিতে সমাজের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। শুধু ব্যঙ্গময় হলেই প্রহসন শিল্প সাফল্য পায় না, প্রহসনটি সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠছে কি না জীবনময়ী হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটক ও উপন্যাস হলোঃ নবীন তপস্বিনী(১৮৬৩) , বিয়ে পাগলা বুড়ো(১৮৬৬), সধবার একাদশী(১৮৬৬), লীলাবতী(১৮৬৭), জামাই বারিক(১৮৭২), কমালকামিনী(১৮৭৩) প্রভৃতি।  দীনবন্ধুর প্রহসনে সময় উপযোগী ব্যঙ্গার্থক ও সমাজের বহিঃবাস্তবতাকে তুলে ধরা হলেও ভেতর থেকে তা জীনময়ী ও শিল্পসঞ্চারী হয়ে উঠেছে। জীবন সম্বন্ধে বাস্তব গভীর অভিজ্ঞতার দ্বারা তিঁনি কল্পনাশক্তির ন্যূনতাকে পূরণ করেছিলেন। তীক্ষ্ণ সমাজদৃষ্টি, জীবনচরিত সৃষ্টি এবং মানবিক সহানুভূতি তার সৃষ্টিকে অমর করে রেখেছে।

গিরিশচন্দ্র (১৮৪৪-১৯১২)  নাট্যকার, নাট্যপরিচালক ও  মঞ্চাভিনেতা হিসেবে খ্যাত ।১৮৮০-১৯০০ সালকে গিরিশকাল বলা হয়। সে সময়ের নাটকযুগে তিঁনি নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। নাটকের বিষয়বস্তু ও প্রয়োগ তুলে ধরেন। প্রত্যেকটি দিক থেকেই গিরিশ্চন্দ্র ঘোষ সফল হলেন। সেগুলির মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি হলো: অভিমন্যুবধ (১৮৮১), সীতার বনবাস (১৮৮১), সীতাহরণ (১৮৮২), পান্ডবের অজ্ঞাতবাস (১৮৮২), প্রফুল্ল (১৮৮৯), জনা (১৮৯৪), আবু হোসেন (১৮৯৬), বলিদান (১৯০৪), সিরাজদ্দৌলা (১৯০৫), মীরকাশিম (১৯০৬), ছত্রপতি শিবাজী (১৯০৭), শঙ্করাচার্য (১৯১০), বিল্বমঙ্গল ঠাকুর ইত্যাদি। ঐতিহাসিক নাটকের মধ্যে সিরাজদ্দৌলা ও মীরকাশিম শিল্প সফল নাটক। প্রেমভক্তি, স্বদেশপ্রেম ও সমকালীন সামাজিক সমস্যা গিরিশচন্দ্রের নাটকের বিষয়বস্ত্ত।

      জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৮ - ১৯২৪) বেশকিছু নাটক রচনা করেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয় নাটক-প্রহসন রচনার মাধ্যমে। অনুবাদ ও হচ্ছিল (ইংরেজি ও সংস্কৃত থেকে) মৌলিক নাটক রচনার বাহিরেও অনান্য নাটক রচনা করা হচ্ছিল কারণ অনেক নাটক মঞ্চায়িত হবে তাই সকল নাটক মৌলিক হতে হবে তেমন কোন নিয়ম ছিল না।  যতীন্দ্রনাথ একক নাটক রচনা করেছেন এবং প্রহসনে তিনি স্বার্থকতা লাভ করেছেন। যতীন্দ্রনাথের মূল কাজ ছিল নাটকের  পৃষ্টপোষকতা করা ঠিক  এই কারণেই আমরা তাকে স্মরণ করি। সংস্কৃত ও ইংরেজি নাটকের অনুবাদ তিনি করেছেন।  যেমন কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুনতলা,  ভগবতীর উত্তরচরিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য  নাটক ও প্রহসন হলো: কিঞ্চিৎ জলযোগ (প্রহসন, ১৮৭২), পুরুবিক্রম নাটক (১৮৭৪), সরোজিনী বা চিতোর আক্রমণ নাটক (১৮৭৫), অশ্রুমতি নাটক (১৮৭৯), স্বপ্নময়ী নাটক (১৮৮২), হঠাৎ নবাব (প্রহসন, ১৮৮৪), অলীক বাবু (প্রহসন, ১৯০০) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। স্বপ্নময়ী (১৮৮০), বসন্তলীলা (১৯০০), ধ্যানভঙ্গ (ওই) নামে গীতিনাট্য রচনা করেন। ভারত-ইতিহাসের পটভূমিতে রচিত নাটকগুলির প্রধান উপজীব্য ছিল স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ। প্রহসনে সমাজের নানা সমস্যার প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল। তিনি মৌলিক নাটক রচনার পাশাপাশি সংস্কৃত, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার বহু সংখ্যক নাটক বাংলা অনুবাদ করেন। 

       অমৃতলাল বসু(১৮৫৩-১৯২৯) ৩৪ টি নাটক লিখেছেন। অনেকগুলো শিল্পসম্মত নাটক রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- হীরকচূর্ণ(১৮৭৫), নীলদর্পণ(১৮৮১), তরুলতা(১৮৯১), চোরের উপর বাটপারি(১৮৯৬) ইত্যাদি।  মীর মোশাররফ হোসেন লিখেছেন বসন্তকুমারী(১৮৭৬) ও জমিদার দর্পণ(১৮৭৬)।

      দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(১৮৬৩-১৯১৩) বাংলা নাটকে অন্যতম সংযোজন। তিঁনি ১৯০৩ সাল পর্যন্ত কাব্য রচনা করেছেন।   তিঁনি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের নাটক লিখেছেন সংস্কৃত নাটকের আঙ্গিকে, আঙ্গিকের পার্থক্য তিনি বুঝেছিলেন। প্রহসনে তিঁনি ইংরেজি নাটকের রীতি গ্রহণ করেছিলেন। এর একটি কারণ হতে পারে প্রহসণে নাটকের জটিলতা থাকে না,  ছোট একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। সংলাপ বাংলা নাটকের প্রাণ আর এই সংলাপ নির্মাণে ও চরিত্র চিত্রণে সাফল্য লাভ করেছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো: পাষাণী (১৯০০), সীতা (১৯০৮), ভীষ্ম(১৯১৪), পরপারে(১৯১২), বঙ্গনারী(১৯১৬), তারাবাই(১৯০৩), রানা প্রতাপসিংহ(১৯০৫), নূরজাহান(১৯০৮), সাজাহান(১৯০৯) ইত্যাদি। 

সুতরাং, বাংলা নাটকের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের যাত্রা শুরু হয় এই উনিশ শতকে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও দীনবন্ধু মিত্র।  শুরুতে সংস্কৃত ও ইংরেজি থেকে অনুবাদকৃত নাটক মঞ্চস্থ হলেও ধীরে ধীরে মোলিক নাটক রচনার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই আন্দোলনে যোগ দেন বাংলার অনেক সৃষ্টিশীল নাট্যকার।  এভাবেই উনিশ শতকে বাংলা নাটক তার নব যাত্রা শুরু করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

The DU Speech-এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন, প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়

comment url